সোনারগাঁয়ে বরাদ্দের নামে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ ইউএনওর বিরুদ্ধে
ফাহাদ, সোনারগাঁ : সোনারগাঁ উপজেলায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা রহমানের বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ তছরূপের অভিযোগ উঠেছে। নামে-বেনামে প্রকল্প তৈরি, অতিরিক্ত বিল ভাউচার করে প্রশাসনের অন্যান্য কর্মচারীদের যোগসাজসে তিনি এ অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। সম্প্রতি উপজেলা অডিটোরিয়ামের সংস্কার কাজে বাজারমূল্য থেকে কয়েকগুণ বেশি দামে বিল পাস করানোর তথ্যও পাওয়া গেছে।
এমনকি কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারকে ছাড়াই ফারজানা রহমানের নির্দেশে কাজ সম্পন্ন করারও অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন কারণে কাজের মূল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মালিকরা তার অনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মালিক এমনটি জানিয়েছেন। এতে কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের (স্কিম কোড ৩৬.৭০৪.২৫.১০২.১২) প্রকল্পের আওতায় মঞ্চের দেয়াল ও ব্যাক ওয়ালে প্যানেলিং, মঞ্চের সিলিং জিপসাম বোর্ড, ভিআইপি চেয়ার, ছোফা, লোহার ফ্রেমের চেয়ার, স্ট্রিপ লাইট, সাউন্ডস সিস্টেমসহ অন্যান্য কাজের ব্যয়ের হিসাব বাস্তবতার চেয়ে বহুগুণ বেশি ধরা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অডিটোরিয়ামের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ও সংস্কার কাজে ব্যবহারের জন্য ২০০টি ভিজিটর চেয়ারের মূল্য ধরা হয়েছে ১০ লক্ষ ৫৫ হাজার ২৪৪ টাকা। যেখানে ১টি চেয়ারের দাম পড়েছে ৫ হাজার দুইশ ৭৬.২২ টাকা। ৫টি সোফার মূল্য ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৬শ ৭৫ টাকা, যেখানে ১টি সোফার দাম পড়েছে ৫১ হাজার ৫শ ৩৫ টাকা। মালামালে বাজার দর থেকে যা কয়েক গুণ বেশি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কানাঘুষা করতে দেখা গেছে। এছাড়া একটি প্রকল্পের আওতায় নারীদের মধ্যে সেলাই মেশিন বিতরণের কথা ছিল।
সম্প্রতি এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নতুন প্রকল্পে সেলাই মেশিন বিতরণের কার্যাদেশ পায়। ইউএনও ওই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে সমঝোতা করে উপজেলায় থাকা পুরাতন প্রকল্পের সেলাই মেশিন বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় ঠিকাদাররা জানান, কাগজ-কলমে উচ্চমানের উপকরণ ব্যবহার করলেও বাস্তবতা তার উল্টো। নির্ধারিত খরচের সঙ্গে বাস্তব মূল্যের বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এ ছাড়া ফারজানা রহমান নিজেই টেন্ডারবাজি করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়াও সংসদ সদস্য ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং পৌর প্রশাসক না থাকায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঠিকাদারদের নামমাত্র মুনাফা দিয়ে তাদের কাছ থেকে কাজ নিয়ে নিজের লোকদের দিয়ে করাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ফারজানা রহমানের বিরুদ্ধে উপজেলার সরকারি বাসভবন মেরামত, উপজেলা পরিষদের অভ্যন্তরের পুকুরের গাইড ওয়াল ও শিশুদের খেলার জায়গা সংস্কারের নামেও অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে।
মারুফ ট্রেডার্সের কর্ণধার ফারুক আহমেদ বলেন, সোনারগাঁ উপজেলা অডিটোরিয়াম সংস্কারের কাজ আমার ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ পেয়েছিল। কিন্তু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা রহমান আমার কাছ থেকে নিয়ে তিনি তার লোকজনের মাধ্যমে অডিটরিয়ামের সংস্কার কাজ বাস্তবায়ন করেছেন। যেহেতু তিনি উপজেলা প্রধান, তাই তার কথা শুনতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বলেন, টিআর, কাবিখা, কাবিটাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইউএনও’র বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করলে অসংখ্য দুর্নীতির প্রমাণ মিলবে।
এছাড়া স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গর্ভনিংবডি সভাপতির দায়িত্বে থাকাকালীন পৌর কর আদায়ের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বন্ধ রেখে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও সহকারী শিক্ষকদের গালমন্দ করে অফিসকক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষক বলেন, উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে একজন ইউএনও শিক্ষকদের সাথে এমন দুর্ব্যবহার করতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না।
এদিকে সামাজিক সংগঠন বিকশিত নারী সংঘের চেয়ারম্যান ফ্রান্স প্রবাসী তৌফিকা শাহেদ জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছেন। সম্প্রতি কাজের প্রয়োজনে ইউএনও’র কাছে গেলে তিনি সহযোগিতা না করে তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবি সমিতির সহ-সভাপতি ও বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট সাদ্দাম হোসেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, পৌরসভার দায়িত্বে থাকা উপজেলা নির্বাহী অফিসার হলুদ সাংবাদিকদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে বলে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করিয়েছেন। উন্নয়নের জোয়ারে এই পৌরসভা এমন ভাসাই ভাসতেছে যে হাঁটা-চলাও করা যাচ্ছে না। হলুদ সাংবাদিকদের ভায়াস্ট করে টাকা মেরে দেওয়ার ধান্দা আর চলবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
এ ব্যাপারে সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারজানা রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে অভিযোগের কথা অস্বীকার করে বলেন, আমি নিজে কোনো কাজ করছি না। ঠিকাদাররাই কাজ করছেন।
তথ্য দিতে অস্বীকৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, সব তথ্য সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করার নিয়ম নেই।