নেত্রকোনায় কৃষকের নেপিয়ার ঘাস চাষে সম্ভাবনার হাতছানি

Share the post
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা: নেত্রকোনায় অনেকেই গরুর খামার গড়ে তুলেছেন। ফলে গো-খাদ্য হিসেবে চাহিদা বেড়েছে ঘাসের। কিন্তু দিন দিন ফাঁকা জমি কমে যাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে ঘাসের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিকভাবে ঘাসের চাষাবাদ হচ্ছে। জেলার কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, নেপিয়ার (বিদেশি হাইব্রিড ঘাস) ও দেশীয় ঘাস নিয়ে কৃষকদের কর্মব্যস্ততা। নেত্রকোনায় নেপিয়ার ঘাস চাষে ঝুঁকেছেন কৃষকরা। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা এ ঘাসে অনেকেই নিজের গবাদি পশুর প্রয়োজন মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করছেন। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তারা। সেই সঙ্গে দেশীয় ঘাস সংগ্রহেও ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় অনেককে। চাষিরা নির্ধারিত সময়ে জমি থেকে ঘাস কেটে স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যান। অনেকে জমির আইল, পুকুর-জলাশয় বা বাড়ির পাশের পতিত জমিতে ঘাস চাষ করছেন। অনেকে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা দেশি ঘাস কেটে পুকুর বা জলশয় থেকে ধুয়ে গবাদি পশুর জন্য বাড়ি নিয়ে যান, কেউ কেউ বিক্রিও করেন এসব ঘাস।
জানা যায়, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম ভারত থেকে নেপিয়ার ঘাস নিয়ে আসা হয়। পরে সেটি স্থানীয়ভাবে চাষাবাদের উপযোগী করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে এ ঘাসের চাষ ছড়াতে থাকে দেশে। নেপিয়ার ঘাসের চারা একবার জমিতে লাগালে তিন বছরের মধ্যে নতুন করে লাগানোর প্রয়োজন হয় না। নেপিয়ার ঘাসে রয়েছে ভিটামিন ‘এ’ যুক্ত ও পুষ্টিগুণ। গবাদি পশুরু প্রিয় খাদ্য হিসেবে এ ঘাসের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সদর উপজেলার আমতলা ইউনিয়নের আফজাল হোসেন জানান, তিনি পেশায় একজন কৃষক। চাষাবাদ ও গরু পুষে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাড়িতে তার পাঁচটি দুধের গাভী রয়েছে। তিনটি গাভী থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩০-৪০ লিটার দুধ পাওয়া যায়। সেই দুধ বিক্রি করে ও কৃষি কাজ করে তার সংসার খুব ভালোভাবেই চলে। তিনি জানান, এক বিঘা জমিতে ঘাস চাষে গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। আর বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকায়। বছরের সাধারণ সময়টাতে প্রতি আঁটি ঘাস ১৫ থেকে ২০ টাকা করে বিক্রি করা হয় এবং কোরবানির ঈদের সময় একই পরিমাণ ঘাস বিক্রি হয় ২০-২৫ টাকায়। প্রতি ছয় সপ্তাহ পর পর ঘাস কাটার উপযোগী হয়। কেন্দুয়া উপজেলার গন্ডা ইউনিয়নের কৃষক আব্দুস সামাদ জানান, কৃষি কাজের পাশাপাশি বাড়িতে গবাদি পশু পালন করেন তিনি। বিঘা খানেক জমিতে লাগিয়েছেন নেপিয়ার জাতের ঘাস। বেশ কয়েক বছর ধরে নেপিয়ার ঘাস চাষ করে আসছেন তিনি। প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের পরামর্শে নেপিয়ার জাতের ঘাস চাষ করছেন। এ ঘাস থেকে তার গবাদি পশুর খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বাজারে বিক্রি করা হয়। তিনি বলেন, অনেকের বাড়িতে দুই থেকে তিনটি করে গবাদি পশু থাকে। তাদের কেউ কেউ প্রতিদিন জমির আইল ও বিভিন্ন ভিটা থেকে দেশীয় ঘাস তুলে সেগুলো পুকুর বা জলাশয়ে ধুয়ে বাড়ি নেন। সবমিলিয়ে বলা চলে, গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে সবুজ ঘাসের গুরুত্ব ও চাহিদা অপরিসীম। পূর্বধলা উপজেলার কৃষক নুরুল ইসলাম ও খোকন মিয়া জানান, নেপিয়ার ঘাসে অনেকেই উপকৃত হয়েছেন। সহজ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায় এবং পরিশ্রম অনেক কম। মাঝে মধ্যে ক্ষেতের ভেতরে জন্মানো আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। তারা বেশ কয়েক বছর ধরে এ জাতের ঘাস চাষ করে আসছেন। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর পরিমাণ ঘাস বাজারে বিক্রি করেন তারা। কৃষকরা জানান, নেপিয়ার ঘাস চাষের জন্য জমিতে মই দিয়ে আগাছামুক্ত করার পর চার-পাঁচটি করে ঘাস একসঙ্গে রোপণ করতে হয়। দুই চোখ (অঙ্কুর) বিশিষ্ট মূল চারার জন্য ব্যবহৃত হয়। সারা বর্ষা মৌসুমেই এ ঘাস লাগানো যায়। তবে বর্ষার শুরু রোপণের উৎকৃষ্ট সময়। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রথম বৃষ্টির পর জমিতে রোপণ করা হলে প্রথম বছরেই তিন-চার বার ঘাস কাটা যেতে পারে। এক সারি থেকে অন্য লাইনের দূরত্ব দুই-তিন ফুট হবে এবং এক চারা থেকে অন্য চারার দূরত্ব হতে হবে দেড় ফুট। মাটিতে রস না থাকলে চারা লাগানোর পর পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। সাধারণত প্রতি একর জমিতে রোপণের জন্য সাত-আট হাজার চারা বা কাটিংয়ের প্রয়োজন হয়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে নেত্রকোনায় ১০টি উপজেলার প্রতিটিতে গড়ে তিনশ কৃষক-পরিবার ২৫ থেকে ৪০ একর করে জমিতে নেপিয়ার জাতের ঘাস চাষ করছেন। তাদের মধ্যে অনেক কৃষক এ জাতের ঘাস চাষের আওতায় এনেছেন। জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গেল বছর জেলার মোট ১০টি উপজেলার প্রায় ৪৬ হাজার ১৫ জন খামারি চার লাখ ২৭ হাজার ২৯৫টি গবাদি পশু লালন-পালন করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। এর বাইরেও দুধের গাভী রয়েছে।
নেত্রকোনা জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ট্রেনিং অফিসার ডাঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান,গবাদি পশুর প্রধান খাদ্য ঘাস। পুষ্টিকর ঘাসে দেহ গঠনকারী আমিষসহ প্রায় সব ধরনের উপাদান মজুদ থাকে। উন্নতজাতের অধিক ফলনশীল ঘাসের মধ্যে নেপিয়ার উল্লেখযোগ্য। খাদ্যগুণ বেশি থাকায় গবাদি পশুর জন্য এ ঘাস বেশ উপাদেয় ও পুষ্টিকর। চাহিদা বেশি থাকায় অন্য ফসলের তুলনায় নেপিয়ার ঘাস বেশ লাভজনক তিনি বলেন, স্বল্প খরচে বেশি মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয় নেপিয়ার ঘাস চাষে। চারণভূমি কমে যাওয়ায় খামারিদের যত ঘাসের প্রয়োজন হয়, তা পূরণে উন্নতজাতের ঘাস চাষের বিকল্প নেই। এ বাস্তবতায় আমরা কৃষকদের বিনামূল্যে উন্নতজাতের ঘাসের কাটিং দিয়ে থাকি। আমাদের দেশে বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য পতিত জমিও আস্তে আস্তে খাদ্যশস্য চাষের আওতায় আনা হচ্ছে। ফলে গবাদিপশু আজ চরম খাদ্য সংকটের সম্মুখীন। এ সংকট সমাধানের জন্য অল্প জমিতে গো-খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উন্নতজাতের ঘাস চাষ করা আবশ্যক। উন্নতমানের ঘাস চাষ করা হলে গবাদি পশুর খাদ্য সমস্যা অনেক কমে যাবে। ফলে মানুষের খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যও বাধাপ্রাপ্ত হবে না। নেপিয়ার উন্নতজাতের ঘাস। এ ঘাসের চাষ পদ্ধতি ও গুণাগুণ সম্পর্কে জানলে অনেকেই চাষ করতে উৎসাহিত হবেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

ভালুকায় মারামারির ঘটনায় আচমকা শুভর নামে গুঞ্জন

Share the post

Share the postআল আমিন ভালুকা, ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহের ভালুকায় ইফতার আয়োজনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাগর আহম্মেদ ইমরানসহ ৩ বন্ধুকে কে মারধরের অভিযোগ উঠেছে একদল কিশোর গ্যাং এর বিরুদ্ধে। ভূক্তভোগী ইমরান ও তার বন্ধুরা উপজেলার উত্তর রাংচাপড়া এলাকার বাসিন্দা। এ ঘটনায় ইমরানের বাবা বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে ভালুকায় মডেল থানায় এক অভিযোগ দায়ের […]

নেত্রকোনায় আওয়ামী নেতা কর্মীরা জামিন না পাওয়ায় আদালত চত্বরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : বিশেষ সূত্রে জানা যায় গত (২৪ ডিসেম্বর) মঙ্গলবার নেত্রকোনায় আদালতে আত্মসমর্পণ করতে গিয়ে জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় আদালতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছেন আসামিরা। এসময় হট্টগোল সৃষ্টি হয়। এই ঘটনার সময় আসামিদের পাশে থাকা এক যুবককে মারধর করার অভিযোগও ওঠেছে। গত মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) দুপুর দেড়টার দিকে এমনই ঘটনা ঘটেছে […]