

সোহেল খান দূর্জয় নেত্রকোণা : ভয় আতংক কিছুতেই যেন পিছু ছাড়ছে না, নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দার সীমান্ত এলাকায় আবার বেড়েছে চোরাচালান। বেপরোয়া হয়ে উঠছে চোরাকারবারীরা। দুই উপজেলার সীমান্ত দিয়ে সব সময়ই আইনশৃংখলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে ভারতীয় চিনি, সিগারেট, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও ফলসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ পন্য দেশের ভেতর আসছে।চোরাচালান নিয়ন্ত্রন নিয়ে একাধিক হত্যাকান্ডের ঘটনাও ঘটছে নেত্রকোনা সীমান্ত এলাকায়। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ওই সমস্ত চোরাচালান নিয়ন্ত্রন করছে বলে জানা গেছে। চোরাচালান নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেত্রকোনায় একাধিক হত্যাকান্ডের ঘটনাও ঘটেছে।কিন্তু সীমান্ত পথে কমছে না চোরাচালান। তবে চেরাকারবারীরা পথ পরিবর্তন করে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। চোরাকারবারীদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ ও বিজিবি। মাঝে মধ্যে চিনি ও মাদকদ্রব্য আটক করা হয় সীমান্ত এলাকা থেকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সীমান্ত এলাকাবাসীর অভিযোগ, চোরাকারবার সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নাম ভাঙ্গিয়ে চোরাচালানীরা হুমকি দিয়ে থাকে। পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ম্যানেজ করেই চলে চোরাকারবার এমন কথাও শুনা গেছে স্থানীয়দের মুখে, তাঁরা আরও বলেন, আগে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সীমান্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো, এখন সীমান্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে বিএনপির নেতাকর্মীরা। এখন অনেকটা অপেন সিক্রেট হয়ে গেছে চেরাচালান।সম্প্রতি নেত্রকোনার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে ভারতীয় চিনি আটক করে আইনশৃংখলা বাহিনী। শুক্রবার (৩০ আগস্ট) নেত্রকোনা মডেল থানা পুলিশ একটি ভারতীয় চিনি বোঝাই ট্রাক আটক করেছে বলে জানা গেছে।
বিশেষ অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারত থেকে অবৈধপথে চিনি, মাদক ও অন্যান্য পণ্য আমদানিকে কেন্দ্র করে ওইসব এলাকায় একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। চোরাকারবারীরা নেত্রকোনার দুর্গাপুরের ভরতপুর, বারোমারি, লক্ষীপুর, বিজয়পুর ও কলমাকান্দা উপজেলার চকলেটবাড়ি, বলমাঠ, কচুগড়া, নক্লাই, কাঁঠালবাড়ি, রামনাথপুর জগন্নাথপুর, পাঁচগাঁও, সন্ন্যাসীপাড়া, কালাপানি, পাতলাবন, বেতগড়া ও চেংগ্নীসহ সীমান্তে বেশ কিছু দুর্গম পথ ব্যবহার করে। প্রথমে সীমান্ত থেকে মাথায় বা কাঁধে করে আনা হয় চিনির বস্তা। পরে সাইকেল, মোটরসাইকেল, রিকশা ও ইজিবাইকে করে স্থানীয় বাজারে নির্দিষ্ট গুদামে চিনি মজুত রাখা হয়। প্রায় প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে ভোর রাত পর্যন্ত চলে চিনিসহ বিভিন্ন পন্য পাচারের কাজ। গুদামে রেখে ভারতীয় বস্তা পাল্টে দেশীয় কয়েকটি কোম্পানির নামে সীলমারা বস্তায় ভরা হয় চিনি। পরে মধ্যরাতে পিকআপ ভ্যান ও ট্রাকে করে জেলার ভিবিন্ন পথ দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।
চোরাই চিনিভর্তি যানবাহন নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য রাতের আধারে সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে ওৎপেতে বসে থাকে লাইনম্যান হিসেবে পরিচিত চোরাচালানিদলের সদস্যরা। অভিযোগ রয়েছে, কলমাকান্দার নাজিরপুর ইউনিয়নের বেতুয়া বাজারে জনৈক প্রভাবশালীর দোকানে ওই সমস্ত ভারতীয় পন্য মওজুদ করা হয়। পরে ভারতীয় প্যাকেট পরিবর্তন করে সুবিধেমত সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। নেত্রকোনা- কলমাকান্দা সড়কে চিনির ট্রাক আটকাতে গিয়ে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ভোরে নেত্রকোনা পৌরসভার রাজুর বাজার এলালায় জাবির মিয়া নামে চোরাচালানীদলের এক সদস্যের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় সাহারা (৩৫) নামে এক নারী সাংবাদিক নিহত ও ফেরদৌসী আক্তার (৪৫) নামে আর একজন আহত হন। সাহারা ও ফেরদৌসী আক্তার অন্য একটি মোটরসাইকেলে চড়ে চোরাই চিনি বোঝাই ট্রাকের ছবি তুলতে চেয়েছিলেন। পরে এ ঘটনায় নিহতের মেয়ে আনজিলা আক্তার মীম বাদী হয়ে অজ্ঞাত সংখ্যক আসামি করে নেত্রকোনা মডেল থানায় মামলা করেন। পুলিশ জাবেরকে গ্রেপ্তার করলেও এ ঘটনায় জড়িত অন্য কোন আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
দুর্ঘটনায় আহত ফেরদৌসী আক্তার জানান, ওই দিন গোপন সূত্রে খবর পেয়ে সড়কে গিয়ে ৪০০ বস্তা ভারতীয় চিনি বোঝাই একটি ট্রাকের ছবি তোলার চেষ্টা করেন তারা। পরে তাদের মোটরসাইকেলটিকে ট্রাকের পেছনে আসা অন্য একটি মোটরসাইকেল ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। এতে তার সহকর্মী সাহারা ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ সময় চোরাচালানীদলের কমপক্ষে ১০ জন সদস্য তাকে মাটিতে পেলে মারধর করে। পরে পুলিশ এসে তাদেরকে উদ্ধার করে। ফেরদৌসীর অভিযোগ, কলমাকান্দা সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন ভারতীয় চিনি দেশের ভেতরে আনা হচ্ছে। এ ছাড়া গত বছরের ৩১ মার্চ রাতে দুর্গাপুর উপজেলার লক্ষীপুর সীমান্তে বাংলাদেশ থেকে সুপারি পাচারের সময় চোরাকারবারীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে টহলরত বিজিবি সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। এসময় আত্নরক্ষার্থে গুলি ছুড়লে বিজিবির গুলিতে আমিনুল ইসলাম নামে এক চোরাকারবারী নিহত হয়। নেত্রকোনার পুলিশ সুপার মো. ফয়েজ আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে পুলিশ কাজ করছে। চোরাচালান রোধে সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত অভিযান চলছে। সীমান্তে গোয়েন্দা পুলিশের অভিযান বাড়ানো হয়েছে।