নকল সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরিতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

Share the post
নকল সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরিতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

চট্টগ্রাম: করোনা আতঙ্কে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সুযোগে বাজারে মিলছে নিম্নমানের মাস্ক। দামি মাস্ক সহজলভ্য না হওয়ায় সচেতন নাগরিকদের আগ্রহ সার্জিক্যাল মাস্কে। তবে কৃত্রিম সংকট তৈরি হওয়ায় এই মাস্কও হয়ে গেছে নকল।

জানা গেছে, একবার ব্যবহারযোগ্য সার্জিক্যাল মাস্ক আগে চীন ও ভারত থেকে আমদানি করে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান নগরের হাজারি লেইন ও রিয়াজউদ্দিন বাজারের সরবরাহ করতো। কিন্তু চীনে মাস্কের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এবং একইসঙ্গে ভারতও রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় দেখা দেয় সংকট। এখন অনেক কোম্পানি দেশে এই মাস্ক তৈরি করছে। তবে এর মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।

চকবাজার এলাকায় নকল সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি করছে হকাররা। ছবি: সোহেল সরওয়ার

বর্তমানে ফার্মেসি বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে একেকটি সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকায়। এ হিসাবে ৫০টি মাস্কের এক বক্সের দাম পড়ছে ১ হাজার থেকে ১২শ ৫০ টাকা। আগে ৫০ পিসের সার্জিক্যাল মাস্কের পুরো বক্সের পাইকারি দাম ছিল ৬০-১শ টাকা। খুচরা বাজারে প্রতি পিস বিক্রি হতো ৩-৫ টাকায়। অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ৫০ পিস মাস্কের প্যাকেট বিক্রি করছে ২ হাজার থেকে ২৫শ টাকায়।

ব্যবসায়ীরা জানান, যে কাপড় দিয়ে একবার ব্যবহারযোগ্য সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরি হয়, বিশ্ববাজারে তার দাম বেড়েছে। পাইকারি বাজারে বর্তমানে একেকটি সার্জিক্যাল মাস্ক ১০ টাকায় পাইকারি বিক্রি করা সম্ভব এবং খুচরায় ১২-১৫ টাকা বিক্রি করা যায়। তবে মধ্যস্বত্বভোগীরা দাম নিচ্ছে দ্বিগুণ। দেশে ‘গেটওয়েল’ ও ‘হ্যালো ইউ’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান মাস্ক তৈরি করলেও তারা চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারছে না।

এদিকে চট্টগ্রামের বাজারে সার্জিক্যাল মাস্কের সংকট থাকায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা নেমেছেন নকল সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরিতে। দেখতে অনেকটা আসল মনে হলেও এই মাস্ক তৈরি হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। কাপড় ব্যবসায়ী, সুদের কারবারি, এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মীরা জড়িয়েছেন এ কাজে। করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষ, গার্মেন্ট কর্মী, গৃহকর্মী ও শিশুদের মাধ্যমে তৈরি কথিত সার্জিক্যাল মাস্ক তারা বাজারে সরবরাহ করছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরের খলিফা পট্টি, চকবাজার-বাদুরতলা, হালিশহর, পতেঙ্গা, কর্নেলহাট সহ বিভিন্ন এলাকায় এখন চলছে নকল সার্জিক্যাল মাস্কসহ বিভিন্ন ধরনের মাস্ক তৈরির ধুম। খলিফা পট্টিতে স্থানীয় কাউন্সিলর চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী মাস্ক তৈরির কয়েকটি কারখানা ঘুরে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মাস্ক তৈরির চিত্র দেখেছেন। এসময় অনেকে তৈরি করা মাস্কের ওপর জুতা-স্যান্ডেল নিয়েও দাঁড়িয়ে ছিলেন।

সরেজমিন পরিদর্শনে এমন চিত্র দেখা গেছে কর্নেলহাটের উত্তর কাট্টলীতেও। সেখানকার কয়েকটি বাড়িতে এজেন্টের মাধ্যমে নন-উভেন থার্মোপ্লাস্টিক শপিং ব্যাগের কাপড় (পিপি-ফেব্রিক্স) দিয়ে তৈরি হচ্ছে নিম্নমানের সার্জিক্যাল মাস্ক। যেসব এজেন্ট এসব মাস্কের কাপড় কাটা ও নোসবার লাগানোর কাজ নিচ্ছে, তারা পেশায় কর্নেলহাটের মাছ ব্যবসায়ী। আর যাদের মাধ্যমে কাজ করানো হচ্ছে, তারা দরিদ্র পরিবারের নারী-পুরুষ ও কিশোর-কিশোরী। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ফেব্রিক্স কাপড় মাটিতে রেখে কাঁচি দিয়ে কেটে সেলাই করার পর দুইপাশে ফিতা লাগানো ও নোসবার স্থাপন কাজ শেষ হলে এসব মাস্ক এজেন্টের মাধ্যমে মূল ব্যবসায়ীর কাছে পাঠানো হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, ফিরোজশাহ এলাকার বাসিন্দা তিন ভাই জুয়েল, রাসেল ও সোহেল মার্কেট থেকে ফেব্রিক্স কাপড় কিনে কর্নেলহাট আমির মার্কেটের অস্থায়ী কারখানায় এনে রোল তৈরি করেন। এরপর সেগুলো শ্রমিক দিয়ে মেশিনে সেলাই করে পাঠানো হয় এজেন্টের কাছে। শাহেরপাড়ার মনু ও সোহেল, পোস্ট অফিস গলির নুরজাহান, উত্তর কাট্টলীর সেকান্দরসহ অনেকে দরিদ্র শ্রমিক দিয়ে রোল থেকে কাপড় কেটে নোসবার বসানোর কাজ করছেন। এজেন্টরা প্রতি মাস্কে ৩০ পয়সা করে কমিশন নেন। মাস্কগুলোকে কারখানায় হিট সিলিং করার পর প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করা হয়। ৫০টি মাস্কের এক প্যাকেট ৫শ থেকে ৬শ টাকায় বিক্রি করা হয়। খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হয় ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। তবে অভিযুক্তদের কাউকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে মনিটরিং বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে ভোক্তা অধিকার বিষয়ক সংগঠন ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী বাংলানিউজকে বলেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি নিম্নমানের এসব মাস্ক স্বাস্থ্য ঝুঁকিই বাড়াচ্ছে। জেলা প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের প্রতিহত করতে হবে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে পারে। পাশাপাশি মানুষকেও এসব ক্ষতিকর মাস্ক বর্জনে এগিয়ে আসতে হবে।

ইতোমধ্যে কয়েক দফায় নগরের আন্দরকিল্লা ও হাজারী লেইন, জামালখান, পাঁচলাইশ, হালিশহর সহ কয়েকটি এলাকায় র‌্যাব-পুলিশ ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সহায়তায় অভিযান চালিয়ে নকল স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীসহ নিম্নমানের মাস্ক বিক্রির দায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক জরিমানা করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত মার্চে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলীয় লোকোশেডে কর্মরত প্রায় আড়াই শ’ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিককে নিম্নমানের মাস্ক দেওয়া হলে তা নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। তবে নকল মাস্ক তৈরিতে জড়িতদের শনাক্ত করা যায়নি।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মনোজ চৌধুরী বলেন, এ জাতীয় কাপড়ের তৈরি মাস্কের উভয় পাশে আলগা আঁশ থাকে। এই আঁশকে বলা হয় মাইক্রো-প্লাস্টিক। এ ধরনের মাস্ক কয়েক মিনিট নাকে-মুখে রাখলে অসংখ্য মাইক্রো-প্লাস্টিক ফুসফুসে ঢুকে যায়। এতে দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুসে ক্যানসার হতে পারে। এছাড়া ছোট কিছু উপাদান রক্তনালিতে গিয়ে স্নায়ুরোগ, ক্যানসার, হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ অন্যান্য রোগের কারণ হতে পারে। তাই এ জাতীয় মাস্ক বর্জন করা উচিত। তার চেয়ে তিন স্তর বিশিষ্ট কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করাই শ্রেয়।

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় নাগরিক আন্দোলন চট্টগ্রামের সংগঠক শরীফ চৌহান বাংলানিউজকে বলেন, এসব অসাধু ও লোভী ব্যবসায়ীর কারণে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। শুধু জরিমানা করে ছেড়ে দিলে তারা বারবার এসব কাজে জড়িয়ে পড়বে। প্রশাসনের উচিত, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করা-যাতে পরবর্তীতে আর এসব অবৈধ কাজ করার সাহস না পায়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

মানবতার ফেরিওয়ালা চট্টগ্রাম মহানগরের উদ্যোগে শীতকালীন কম্বল বিতরণ

Share the post

Share the postচট্টগ্রাম সংবাদ: মানবতার ফেরিওয়ালা চট্টগ্রাম মহানগর শাখার পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম নগরীর মধ্যরাতে নগরের জামালখান,চকবাজার,চট্টগ্রাম মেডিকেল,ওয়াসা,কাজির দেউড়ি,সিআরবি,দেওয়ানহাট সহ বিভিন্ন স্থানে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। রাতের আঁধারে এই তীব্র শীতে কষ্ট পাচ্ছে, তাদের কষ্টকে লাঘব করতে এই শীতকালীন কম্বল বিতরণ করা হয়। মানবতার ফেরিওয়ালার প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মশিউর রহমানের নির্দেশনা মোতাবেক মানবতার ফেরিওয়ালার চট্টগ্রাম […]

সামাজিক সংগঠন”মানবতার ফেরিওয়ালা” চট্টগ্রাম মহানগরের কমিটি ঘোষণা

Share the post

Share the postচট্টগ্রাম সংবাদ: “মানবতার ফেরিওয়ালা” সামাজিক সংগঠনের কার্যক্রম বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম মহানগর এর আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। গতকাল ১০ই অক্টোবর সামাজিক সংগঠন মানবতার ফেরিওয়ালা সংগঠনের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে মানবতার ফেরিওয়ালা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মশিউর রহমানের স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপনে এই কমিটিঘোষণা করা হয়। উক্ত কমিটিতে সভাপতি নির্বাচিত হন কাজী ইসতিয়াক আলম […]