সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা পরিচয়ে চাকুরি দেয়ার নামে কোটি টাকা আত্মসাত
ইয়াসিন আরাফাত,চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি : নিজেকে পরিচয় দিতেন সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে। কর্মক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করতেন সোনালী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা। এই পরিচয় দিয়েই শশুরবাড়ির পরিবার ও এলাকায় তরুণ-যুবকদের প্রলোভন দেখাতেন বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ সরকারি চাকুরি দেয়ার। এভাবেই চাকুরি দেয়ার নামে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর থেকে পলাতক রাজশাহীর শীর্ষ প্রতারক শামসুন নাহার সুমি (২৯)।
প্রতারক শামসুন নাহার সুমি রাজশাহীর চন্দ্রিমা থানার বিহারী কলোনর দুই নাম্বার গলির মৃত সামিউল আলমের মেয়ে। প্রতারণার ঘটনায় একাধিক মামলা হলেও দীর্ঘদিন ধরেই সপরিবারে পলাতক রয়েছেন সুমি। আদালত ওয়ারেন্ট ইস্যু করলেও তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের শেষ দিকে পরিবার ও সমাজে নিজের সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে চাকুরি পাওয়ার খবর ছড়ায় শামসুন নাহার সুমি। এরই জেরে তার তৎকালীন দেবর (স্বামীর ভাই) মো. সাখাওয়াত হোসেনকে জানায় ব্যাংকে কু-ঋণের জন্য টাকা প্রয়োজন। পরিবারও তখন তার চাকুরির বিষয়টি স্যতি জেনে ২০১৯ সালে মোট ২৫ লাখ টাকা ধার দেয় দেবর কোরিয়া প্রবাসী সাখাওয়াত হোসেন। যার লেনদেনের ব্যাংক স্টেটমেন্টে প্রমাণ পাওয়া যায়।
আরও জানা যায়, একই পরিচয় দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্তত ৮ জন যুবকের কাছে জনপ্রতি ৫-৮ লাখ টাকা করে নেয় বিভিন্ন সরকারি চাকুরি দেয়ার নামে। কিন্তু বিপত্তি বাধে সকলের টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর। টাকা নিয়েই পালিয়ে যায় প্রতারক শামসুন নাহার সুমি৷ নিজেকে সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পরিচয় দিলেও সেখানে তার কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
কোটি টাকা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা প্রবাসী সাখাওয়াত হোসেন ও চাকুরি প্রত্যাশী যুবকরা। কোরিয়া প্রবাসী সাখাওয়াত হোসেন জানান, আমরা পরিবারের লোকজন জানতাম সে সোনালী ব্যাংকে চাকুরি করে। অথচ আমাদেরকেও মিথ্যা বলে দফায় দফায় মোট ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমরা মামলা করেও তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। রাজশাহীর চন্দ্রিমা থানা পুলিশ আটক করছে না। আমার মামা বাদি হয়ে মামলা দায়ের করলেও সে আদালতে হাজির হয়নি। শুধু আমার সাথে নয়, এমন কাজ করেছন আরও অনেক যুবকের সাথে, যারা সবাই চাকুরি প্রত্যাশী ছিল।
এ ঘটনায় প্রবাসী সাখাওয়াত হোসেনের মামা মো. খলিলুর রহমান। মামলায় প্রধান আসামী করা হয়েছে প্রতারক শামসুন নাহার সুমিকে। অন্য আসামীরা হলেন, সুমির মা মোসা. নাজমা বেগম (৫০), বোন সোনিয়া খাতুন এবং তাদের সহযোগী চাঁপাইনবাবগঞ্জের নয়ালাভাঙ্গা গোয়ালপাড়া গ্রামের মৃত এরফান আলীর ছেলে মো. মইনুদ্দিন চিশতি (৫০)।
নাচোলের যুবক তারেক রহমান বলেন, সেনাবাহিনীতে চাকুরি দেয়ার কথা বলে আমার কাছে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। নিজেকে সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পরিচয় দিয়ে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকতাদের সাথে যোগাযোগ আছে বলে টাকা নেয়। জমি বিক্রি করে ও দুটি এনজিও থেকে ঋণ করে তার হাতে চাকুরির আশায় টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে জানতে পারলাম, পালিয়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে মামলা করেও কোন লাভ হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চাকুরি প্রত্যাশী বলেন, রাজশাহী কলেজ অনার্স-মাস্টার্স পাশ করার পর বেকার জীবন পার করছিলাম। এমন অবস্থায় সোনালী ব্যাংকে চাকুরি দেয়ার অফার দেন শামসুন নাহার সুমি। তাতে রাজি হলে ৩ লাখ টাকা দাবি করেন। এমনকি আমাকে রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়। এমনকি সোনালী ব্যাংকের রাজশাহী শাখাতেও কিছু সময়ের জন্য নিয়ে যায়। এরপর টাকা নিয়েও লাপাত্তা হয়ে যায় সুমি। পরে জানলাম সে কোন চাকুরি করতো না সোনালী ব্যাংকে। ভুয়া পরিচয় দিয়ে টাকা আত্মসাত করেছে।
রাজশাহীর সোনালী ব্যাংক শাখাতেও শামসুন নাহার সুমির কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি৷ নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানকার এক কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, গত ৬ বছরের মধ্যে আমার দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে শামসুন নাহার সুমি নামের কোন কর্মকর্তা ছিল না। সুমির পরিচয় দেয়া হলে ওই ব্যাংক কর্মকর্তা আরও জানান, এই মহিলা সোনালী ব্যাংকের কোন শাখাতেই কখনোই চাকুরি করেননি। সোনালী ব্যাংকের নাম ব্যবহার করে কেউ প্রতারণা করলে সে দায় একান্ত তার। যথাযথ কর্তৃপক্ষ এবিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হরহামেশায় তাকে সোনালী ব্যাংকের নাম-লোগো সংবলিত আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে চলাফেরা করতে দেখা যেতো। এমনকি তার জীবনযাপনও ছিল বিলাসী। তার বাবা একজন দিনমজুর হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ তার জীবনযাপন ছিল আলিসান। লাখ লাখ টাকা মূল্যের জুয়েলারী ব্যবহার করতেন সুমি। যার সবই এমন প্রতারণার টাকায় বলে জানা যায়।
এবিষয়ে রাজশাহীর চন্দ্রিমা থানার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি ভুয়া ব্যাংক কর্মকর্তা শামসুন নাহার সুমি ও তার পরিবারের ফোন নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। তাদের বাসায় গেলেও তাদেরকে পাওয়া যায়নি। তথ্য রয়েছে, কয়েকদিন পরপর বাড়ির ঠিকানা পরিবর্তন করে প্রতারণা করেন শামসুন নাহার সুমি।