কালের বিবর্তনে নেত্রকোনায় হারিয়ে যাচ্ছে পিঁড়িতে বসে চুল-দাঁড়ি কাটার নাপিত সম্প্রদায়

Share the post
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : কালের বিবর্তনে নেত্রকোনায় বর্তমানে শহর-বন্দর ও গ্রামের হাটবাজার গুলোতে রয়েছে এসি ও নন-এসি সেলুন। কালের বিবর্তনে আজ পুরুষদের জন্যও ব্যবস্থা করা হয়েছে পার্লার। সে সব সেলুন ও পার্লারের চুল ও দাঁড়ি কাটার জন্য রয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও মেশিন। তবে কালের এই বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে নাপিত সম্প্রদায়ের চুল ও দাঁড়ি কাটার চিত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্য অনেক পেশার মতোই নাপিতদের এই পেশা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তারপরও কখনও কখনও গ্রামাঞ্চলের হাঁট-বাজারে চোখে পড়ে ভ্রাম্যমাণ তাদের কর্মযজ্ঞ।আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ফলে আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গতিধারায় এসেছে পরিবর্তন, লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। আধুনিক সভ্যতায় গড়ে উঠেছে আধুনিক মানের সেলুন। কদর বেশি হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকছেন সেই সব সেলুন গুলোর দিকেই। এখনো হাঁট-বাজারে, খেয়াঘাটে, ফুটপাতের কিংবা গ্রামগঞ্জের জলচৌকিতে বা ইটের ওপর সাজানো পিঁড়িতে বসে চুল-দাঁড়ি কাটে নাপিতরা। হাঁটুর নিচে মাথা পেতে আবহমান বাংলার মানুষের চুল-দাঁড়ি কাটার রীতি চলে আসলেও সেই আদি পরিচিত দৃশ্য এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না। হারানোর পথে আবহমান কাল ধরে চলে আসা এই গ্রামীণ ঐতিহ্য। নেত্রকোনা জেলার প্রতিটি উপজেলার অনেক হাঁট-বাজারে এখনো চোখে পড়ে চির চেনা এই দৃশ্য। অল্প খরচের কথা মাথায় রেখে এখনো তাদের কাছে অনেকেই চুল-দাঁড়ি কাটান।
এদিকে কেন্দুয়া উপজেলার কান্দিউড়া ইউনিয়নের কান্দিউড়া গ্রামের অনুকুল বিশ্বাস ও সুনীল বিশ্বাস বাবা ছেলে। বংশ পরিক্রমায় হয়েছেন নাপিত। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এ পেশায় আছেন। এই উপজেলার চিরাং ইউনিয়নের চিরাং বাজার,বৈরাটি বাজার,রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নে রোয়াইলবাড়ী বাজারসহ  বিভিন্ন বাজারে আগে দেখা যেত নাপিতদের।এখন আর তাদের খুব একটা দেখা যায় না। দেখা যায় না  হাঁটে-বাজারে খোলা আকাশের নিচে বসে চুল-দাঁড়ি কাটানো। এখনো যারা আছেন তারা হাঁটে-বাজারে জলচৌকিতে বসে কাঠের বাক্স যার মধ্যে ক্ষুর, কাঁচি, চিরুনি, সাবান, ফিটকিরি, পাউডার ও লোশন নিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষকে সুন্দর করে যাচ্ছেন। নাপিত অনুকুল বিশ্বাস বলেন, আমার দাদা এই পেশায় ছিলেন,তারপর আমার বাবা এই পেশায় এসেছেন,  আর এখন আমি এই পেশা ধরে রেখেছি। আমরা তিন ভাই। অন্য ভাইয়েরা এই পেশা পছন্দ করে না, তাই অন্য পেশায় চলে গিয়েছে। বাবা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন তাই কম আসেন। তিনি আরো বলেন,অনেক বছর আগে চুল কাটা বাবদ দিতে হতো দুই টাকা  আর দাঁড়ি কাটার জন্য এক টাকা। সে সময় যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলতো। কিন্তু বর্তমানে ২০ টাকায় চুল ও ১০ টাকা দাঁড়ি কেটেও সারা দিন যে টাকা উপার্জন হয় তা দিয়ে সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করতে তাদের হিমশিম খেতে হয়।
পূর্বে আমরা বার্ষিক চুক্তিতে কাজ করতাম। কিন্তু বর্তমানে সেই নিয়ম নেই। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বর্তমানে পরিবর্তন এসেছে চুল-দাঁড়ি কাটার সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতিতে। সে সব সেলুনে এখন আর শান দেওয়া ক্ষুর দেখা যায় না। তার বদলে এসেছে ব্লেড লাগানো ক্ষুর। এসেছে শেভিং ক্রিম, লোশন ব্লোয়ার, চুলের কলপ। তিনি যখন একাজ শুরু করেন তখন এগুলো ছিল তার কাছে কল্পনাতীত।সুদর্শন দেবনাথ নামে এক ব্যক্তি বলেন, এখন তো উপজেলায় অনেক আধুনিক সেলুন আছে। কিন্তু যখনই বাজারে যাই, ওই চুল কাটা দেখলে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। কারণ তারা যখন চুল কাটতো, দুই হাঁটু দিয়ে আমাদের ঘাড় চাপ দিয়ে ধরতো, যেন নড়াচড়া না করতে পারি। ফলে যখন চুল কাটতো, তখন তার হাঁটুর ওপর ঘুমিয়ে পড়তাম। চিরচেনা দৃশ্য ছোটবেলার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। অন্যদিকে নেত্রকোনা সদর উপজেলার রেজাউল করিম নামে অপর ব্যক্তি বলেন, ছোট বেলায় বাবার সঙ্গে যেতাম। চুল কাটাতে তাদের দায়িত্ব দিয়ে বাবা বাজারের সব কাজ শেষে আসতেন। এখন আর তাদের কাছে চুল-দাঁড়ি কাটায় না। ছেলে-মেয়েদের চুল ও কাটায় আধুনিক সেলুন গুলোতে। আমরা এখনো এদৃশ্য নিজের চোখে দেখলেও, এমন একটা সময় আসবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে যখন গ্রামের বাজারে পিঁড়িতে বসে হাটু ঘেরে চুল কাটার গল্প নিছক অকল্পনীয় মনে হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলমের বাসভবনে ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে মুছে ফেলা হয়েছে

Share the post

Share the post হৃদয় আহমেদ ভালুকা, ময়মনসিংহ: রক্তাক্ত জুলাই আগষ্ট চেতনার গ্রাফিতি। গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করার পর বিপ্লবী চেতনা ধরে রাখতে শিক্ষার্থীরা ময়মনসিংহ নগরীর বাসা বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি বেসরকারি অফিস ও আদালতসহ জেলা প্রশাসকের সরকারি বাসভবনের দেয়াল জুড়ে জুলাই-আগষ্ট চেতনার গ্রাফিতি অঙ্কন করেছি। বিপ্লবী শিক্ষার্থীদের আঁকা সেই রক্তাক্ত জুলাই আগষ্ট […]

ময়মনসিংহ মহাবিদ্যালয় এর উদ্যোগে গাজায় চলমান গণহত্যার প্রতিবাদে অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ মিছিল

Share the post

Share the postনিউজ রিপোর্ট:৮ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার – ময়মনসিংহ মহানগরের অধীনস্থ ময়মনসিংহ মহাবিদ্যালয় ছাত্রদল গাজায় চলমান ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার প্রতিবাদে একটি অবস্থান কর্মসূচি এবং বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন করে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে তারা বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানায়, গাজায় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে।   মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রদল সদস্যরা সকাল ১১ টার দিকে মিছিলটি শুরু […]