এখনো ছেলের কবরের পাশে বসে কাঁদেন কোটা আন্দোলনে নিহত রমজানের মা
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : এখনো ছেলের কবরের পাশে বসে কাঁদেন কোটা আন্দোলনে নিহত রমজানের মা,‘বিচার দেওয়ার জায়গা নাই,আল্লাহর কাছেই বিচার দিলাম’ছেলের কবরের পাশে বসে এভাবেই কাঁদছেন প্রতিদিন রমজানের মা। তখন কোটা আন্দোলনের কারণে সহিংসতা ঘিরে সারাদেশে ছিল কারফিউ। কাজে যেতে হবে তাই খালুর সাথে গত (১৯ জুলাই) সকালে রাজধানীর রামপুরা এলাকার ওমরআলী গলিতে একটি রেস্টুরেন্টে যান খেতে যান রমজান। তখন খালু গোলাম মোস্তফা আগে রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়েছেন। পেছনে যাচ্ছেন রমজান। দরজার কাছ পর্যন্ত যেতেই সামনে থেকে হঠাৎ একটা গুলি এসে রমজানের গলায় ঢুকে পড়ে। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রমজান। উপস্থিত লোকজন তাকে রিক্সায় তুলে কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়।পরিস্থিতি খারাপ দেখে চিকিৎসক দ্রুত রমজানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। তবে ঢামেকে নিয়ে যাওয়ার পথেই তখন রমজানের মৃত্যু হয়। পরে আর ঢামেকে না গিয়ে বাসায় নিয়ে আসা হয় বাড়িতে।
এদিনই পিকআপে করে লাশ গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার সদর উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের নন্দীপুর গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ১১টায় লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি পৌছে স্বজনরা। পরে রাত ১২টায় জানাযা নামাজ শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মো. রমজান (২৪) নেত্রকোনার সদর উপজেলার নন্দীপুর গ্রামের মো. লিটন মিয়ার ছেলে। লিটন মিয়ার দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় রমজান। রমজান তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার ছোট ভাই শাহীন স্থানীয় কলেজে একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। গ্রামের একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ৪-৫ বছর আগে রোজগারের উদ্দেশ্যে রাজধানীতে যায় রমজান। রামপুরা এলাকায় একটি কেক-বিস্কুট কোম্পানিতে সেলসম্যানের কাজ করতো রমজান। এই প্রতিনিধি কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত নেত্রকোনার সদর উপজেলার নন্দীপুর গ্রামে রমজানদের বাড়িতে গেলে তার বাবা লিটন মিয়া এসব তথ্য জানান। এসময় রমজানের মা মনেয়ারা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রতিবেশীরা জানায়, লিটন মিয়া খুবই দরিদ্র মানুষ। টিন বাঁশের ছোট একটা ভাঙাচোরা ঘর আর বাড়ির জায়গা ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই তার। আগে দিনমজুরি করে সংসার চালিয়েছে। পাশাপাশি পোলাপান গুলো বড় করেছে। এখন আর কাজ করতে পারে না। বড় ছেলে রমজান কয়েক বছর ধরে ঢাকায় কাজ করে সংসারটা চালাচ্ছে। একমাত্র উপার্জনশীন ছেলের মৃত্যুতে পরিবারটা মহা বিপদে পড়েছে পরিবারটি। রমজানের বাবা লিটন মিয়া জানান, রমজানের আয় দিয়েই আমাদের পরিবার চলতো। অন্য দুই ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করতো। তার মৃত্যুতে আমাদের সব শেষ হয়ে গেল। এই মৃত্যুর বিচার চাওয়ারও জায়গা নেই। আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। বাবার ঘাড়ে সন্তানের লাশ কতটা ভারী, কতটা বেদনার, সেটা শুধু একজন সন্তান হারা বাবাই জানে।
রমজানের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পথে যখন রমজানের মৃত্যু হয় তখন লাশ সরাসরি বাসার দিয়ে আসে। কিন্তু বাসার সামনে থেকে পুলিশ রমজানের লাশটা বেওয়ারিশ দাবি করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সেখানে উপস্থিত আমার বোনের মেয়ে ও আত্মীয় স্বজনরা বলছিল যে, আমরা এতসব আত্মীয় স্বজন থাকতে রমজান বেওয়ারিশ হলো কেমনে? কিন্তু পুলিশ কোনো কথা না শোনে লাশ নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরে আমার বোনের মেয়ে খোঁজাখুঁজি করে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি জানিয়েছে। পরে তাঁর সহায়তায় লাশটা বাড়ি আনতে পেরেছি। নইলে তো আমার ছেলেকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারতাম না। এখন তো আমার ছেলের কবরটা অন্তত দিতে পেরেছি। কবরের সামনে গিয়ে কেঁদে মন হালকা করতে পারছি। লাশটা নিয়ে গেলে তো তাও সম্বব ছিলো না। মনোয়ারা বেগম আরও বলেন, ছেলে হারানোর ব্যাথা বলে বোঝানো যাবে না। কোনকিছুতেই এই ব্যাথা যাবে না। আমার ছেলে তো কোনো আন্দোলনেও যায়নি, কারো কোনো ক্ষতিও করেনি। কাজ করে রোজগার করছিল। তবুও তাকে হত্যা করা হলো। এ বিচার কার কাছে দেব। আল্লাহর কাছেই এর বিচার দিলাম। দিন যাবে, মাস যাবে, বছর যাবে আমার ছেলে আর আসবে না। রমজানের মা বলেন, আমি দেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি জানাই তারা যেন আমার ছেলের হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে দ্রুত বিচার করেন। প্রতিবেশী জামাল মিয়া বলেন, রমজান ছেলেটার মধ্যে খুবই আদব ছিল। অমায়িক ছেলে ছিল। আল্লাহ তাকে বেহেশত দান করুক। দরিদ্র পরিবার একমাত্র উপার্যনশীল ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় হয়ে গেছে। দেশে শান্তি ফিরুক এটাই আমাদের চাওয়া।