বোয়ালখালীবাসিকে করোনা থেকে বাঁচাতে ইউএনও ও এসিল্যান্ডের যুদ্ধ
মুহাম্মদ সাইফুদ্দিন খালেদ, (বোয়ালখালী প্রতিনিধি): এ যেন এক অন্যরকম যুদ্ধ। অস্ত্র আর বুলেট ছাড়াও যে যুদ্ধ করতে হয় তা আজ দেখছে বিশ্ববাসি। এই যুদ্ধ কোন প্রতিপক্ষের সাথে নয়, নয় ক্ষমতার জন্য। এযুদ্ধ কেবলই একটি ভাইরাস থেকে বাঁচার যুদ্ধ। সারাবিশ্ব আজ থমকে গেছে মহামারি করোনা ভাইরাসে। যাতায়াত বিচ্ছিন্ন প্রায় সবদেশ।
প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত এবং হাজার হাজার মানুষ মুহুর্তেই মৃত্যুবরণ করছে। ইতিমধ্যে মৃতের সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীরা এই মহামারি রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারে দিন-রাত প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে গেলেও আজও তার কোন সঠিক প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি। মানুষ যখন এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তখন সব দেশের সরকার জনগণকে এই মহামারি ভাইরাস থেকে বাঁচতে ঘরে থাকার নির্দেশ দিচ্ছে। বলছে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে।
যে সমস্ত স্থানে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া যাচ্ছে ঐসমস্ত স্থান লকডাউন করে দেয়া হচ্ছে। বলতে গেলে একপ্রকার গৃহবন্দি হয়েই পড়েছে জনসাধারণ। এতে করে বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষেরা। অপরদিকে সাধারণ মানুষদেরকে ঘরে থাকতে বললেও কিছু মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই মহামারি থেকে মানুষদের বাঁচানোর চেষ্টায়। সকাল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত ক্লান্তিহীনভাবে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে চলতে চলতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে রাত হয়ে আঁধার নেমে আসে তা বুঝতেই পারেনা। ভুলে যাই সঠিক সময়ে খাবারের কথা। অনেক সময়তো অভিযান চলাকালে পথ চলতে চলতে গাড়িতেই সেরে নিতে হয় দুপুর কিংবা রাতের খাবার। এভাবেই কাটছে প্রতিটি মুহুর্ত। সবশেষে বাসায় গিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি শেষে একটু বিশ্রাম নেয়া। আর এই মানুষগুলির মধ্যে সরকারি দুই কর্মকর্তা বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আছিয়া খাতুন এবং সহকারি কমিশনার (ভূমি) মোজাম্মেল হক চৌধুরী। প্রতিদিন চায়ের দোকান থেকে শুরু করে হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট, গ্রামের অলিগলিতে সর্বক্ষণ পাহারাদারের মতো করে ঘুরে ঘুরে
বোয়ালখালীবাসির নিরাপত্তায় নিজেদের জীবনের শ্রেষ্ঠ মূহুর্তগুলি অতিবাহিত করছেন। যে কোন স্থান থেকে সমস্যার খবর পেয়ে মুহুর্তে ছুটে গিয়ে সমাধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের এমন তৎপর কর্মকান্ডে খুশি বোয়ালখালীর জনগণ। সর্বত্র প্রশংসিত হচ্ছেন সকলের কাছে। ইতিমধ্যে এই দুই ব্যক্তিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের প্রশংসা করে পোষ্ট দিয়েছেন। তারা তাদের পোষ্টের মাধ্যমে বিরামহীন পথচলার এই দুই মানুষকে তাদের কর্মের ধন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। অনেকে তাদের যুদ্ধা বলেও অবহিত করেন। জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আছিয়া খাতুন চ্যানেল-২১ কে বলেন, বোয়ালখালী এটা আমার পরিবারের মতো। এখানে আসার পর থেকে মানুষকে সঠিকভাবে সেবা দিয়ে আসছি। সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম-৮ আসনের মাননীয় সংসদ আলহাজ্ব মোছলেম উদ্দিন আহমদের সহযোগীতা ও দিক-নির্দেশনা মতো আমরা মানুষের সেবায় সর্বক্ষণ কাজ করে যাচ্ছি। মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভার থেকে জনগণকে সচেতন করা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য। তবে আমরা যে যুদ্ধে নেমেছি সেযুদ্ধে জয়ী হতে হলে জনগণকেও সচেতন হতে হবে। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবেনা। বোয়ালখালীকে লকডাউনের প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো সেরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি, যদি পরিস্থিতির অবনতি হয় তাহলে সেটা তখন উপরোস্থ কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বোয়ালখালীর সনাক্ত হওয়া রোগীটির সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে জানান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ধরণের মহামারি আমি আমার জীবনে আগে কখনো দেখিনি। এটি সমপূর্ণ নতুন আর এর থেকে অনেক কিছু অভিজ্ঞতা হচ্ছে। যদিওবা কাজ করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি রয়েছে, পরিবারের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তা রয়েছে তবুও দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করতে পারছি সেটাই জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া বলে মনে করছি।
সহকারি কমিশনার (ভূমি) মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, জনগণকে সচেতন করতে ও মহামারি থেকে রক্ষার্থে সর্বদা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে সরকারি নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরোদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে বেশিরভাগ মানুষ এখনো অবহেলা করে আড্ডা ঘুরাঘুরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আমরা যখন যে স্থান দিয়ে অভিযানে যাই আমাদের দেখে তারা সটকে পড়ে। তারা মূলত আমাদের ভয় পাচ্ছে ভাইরাসকে নয়। আল্লাহ না করুক এই অবহেলা যেন কারো বিপদ হয়ে না দাঁড়ায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সবচেয়ে বড় ভয় আমার ৬ মাসের একটা বাচ্ছা আছে কিন্তু আমি এখনো তার মুখ থেকে বাবা ডাকটি শুনতে পারিনি। আমার যদি কিছু হয়ে যাই তাহলে তাদের কি হবে। আমার স্ত্রী আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত। আমার মা প্রতিদিন আমাকে ফোন করে জানতে চাই আমি কেমন আছি। পরিবারের এই ভালোবাসা থেকে দুরে থাকাটা সত্যিই খুব কষ্টের। এসবের মধ্যেও দেশের প্রতি সম্মাণ রেখে জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। কেননা মানুষ মানুষের জন্য। সর্বক্ষণ অভিযানের পরেও মানুষ অযথা বাইরে ঘুরাফেরা করার কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণত একজন মানুষ কতক্ষণ ঘরে থাকতে পারে এটি অনেকেরই প্রশ্ন। তবে আমার মনে হয় আমাদের দেশে যদি উন্নত দেশগুলির মতো সকলের জন্য সুযোগ সুবিধা থাকতো যেমন স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট, ওয়াইফাই এবং সামাজিক বিনোদনের ব্যবস্থা করা যেত তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও ঘরে থাকার চেষ্টা করতো। তিনি আরো বলেন আমাদের বাংলাদেশের মানুষ বেশি আবেগী কোন একটা ঘটনা ঘটলেই সবাই ভিড় জমায়। আমরা একসময় দেখতাম সবাই পাড়া মহল্লায় মরব্বিদের কথা শুনতো, তাদের মানতো, কিন্তু এখন অনেকেই মুরব্বিদের তেমন মানতে চাইনা, যে যার যার মতো করে চলে। আরো একটি বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশে নিম্ম মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যায় বেশি যার ফলে তারা কর্মহীন হয়ে পড়াতে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে কাজের সন্ধানে বের হচ্ছে। তবুও আমরা চেষ্টা করি তাদের বুঝানোর জন্য। আমি সকলের কাছে আবারো অনুরোধ করবো একটু কষ্ট হলেও অহেতুক ঘুরাফেরা না করে ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন, আপনাদের সেবায় আমরা সর্বাত্বক কাজ করে যাচ্ছি। ইউএনও ও এসিল্যান্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইচ চেয়ারম্যান শামীম আরা বেগম বলেন, উপজেলা প্রশাসনের ইউএনও এবং এসিল্যান্ড অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ব্যক্তি। পরিষদটিকে তারা যেভাবে কর্ম ও দক্ষতার মাধ্যমে পরিচালিত করছেন তা সত্যি প্রশংসনীয়। তারা একের পর এক অতুলনীয় কাজ করে যাচ্ছেন যা দেখে মুগ্ধ না হওয়ার উপায় নেই। পৌরসভা আওয়ামীলীগের আহবায়ক সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী জহুরুল ইসলাম জহুর বলেন, দেশের এই ক্লান্তিলগ্নে প্রশাসনের এই দুইজন ব্যক্তি যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তা সত্যি প্রশংসার দাবিদার। বোয়ালখালীবাসি তাদের এই সহযোগীতা আজীবন মনে রাখবে। আমি সর্বাত্বক তাদের মঙ্গল কামনা করছি। বোয়ালখালী পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও উপজেলা বিআরডিবির চেয়ারম্যান শাহজাদা এস.এম মিজানুর রহমান বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আছিয়া খাতুন এবং সহকারি কমিশনার (ভূমি) মোজাম্মেল হক চৌধুরীর মতো মানুষ পেয়ে আমরা সত্যি সৌভাগ্যবান। দুজনই অত্যন্ত সৎ নিষ্ঠার সাথে প্রশাসনের কাজসমূহ করে যাচ্ছেন। প্রশাসনের প্রতিটি কাজে তাদের সহযোগীতা পেয়ে থাকি। বোয়ালখালী পৌরবাসির পক্ষ থেকে তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এছাড়াও প্রশাসনকে বোয়ালখালী থানা পুলিশ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী টিম সর্বক্ষণ সহযোগীতা করে যাচ্ছেন। বিশ্ব আজ থমকে গেছে, অর্থনৈতিক কার্যক্রম এক প্রকার বন্ধ বললেই চলে। বিশ্ববাসি এই মহামারি থেকে কবে মুক্তি পাবে তা কারো জানা নেই। অপরদিকে মানুষ সৃষ্টিকর্তার প্রতি দুহাত তুলে প্রার্থনা করছেন তিনি বিশ্ববাসিকে এই মহামারি থেকে রক্ষা করে আবারো আলোর পথ দেখাবেন এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।