প্লাজমা থ্যারাপী কি সময়ের অন্ধের ষষ্ঠী? – প্রেক্ষিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বিধি।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর চলমান ক্রান্তিলগ্নে যখন বাঁচার দিশা হয়ে কোভিড-১৯ চিকিৎসাপদ্ধতির অবতাররূপে আবির্ভূত হলো ‘কনভালেসেন্ট ব্লাড প্লাজমা থ্যারাপী’, দিকে দিকে বাস্তবায়নে আসতে লাগলো বিস্ময়কর সাফল্য, তখন হঠাৎ করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)’র হালনাগাদ করা অন্তর্বর্তীকালীন একটি জরুরী নীতিমালা (Interim Guidelines)’য় উল্লেখিত প্লাজমা থ্যারাপীর বিষয়টা নিয়ে সোর উঠলো চারিদিকে! হুট করেই বহুলভাবে গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত একটি উদ্যোগ আবারো মুখ থুবড়ে পড়তে লাগলো আমাদের অবোধ্য সমালোচনা ও নিন্দারঝড়ের মুখে। মূলত, ‘ছাগলের ৩ নং বাচ্চার’ ফিনোটাইপিক স্বভাবটা আমাদের শরীরে জেনেটিকেলি কোড করা বিবর্তনের সূত্রে; বুঝি না বুঝি একটা বিষয় হুট করে গিলতেও যেমন আমরা বিলম্ব করিনা, আবার মুহূর্তে বমি করতেও দ্বিতীয়বার ভাবিনা! এই দ্বিধান্বিত সমস্যা প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি হতে পারে সাংবাদিক ভাইদের; তাদের আরেকটু দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে এইক্ষেত্রে। প্রতিটি বিষয়ের কেবল ঋণাত্মক পাশটা প্রকাশ না করে, এর গ্রহণযোগ্য দিকগুলোও যথাযথ গবেষণার ভিত্তিতে সাধারণের কাছে তুলে ধরাটা তাদেরই নৈতিক কর্তব্য। কেননা, আমি বিশ্বাস করি সাংবাদিকতা মুক্ত বুদ্ধিচর্চার একটি উচ্চমার্গীয় প্রয়াস; আর তাই প্রতিটি সাংবাদিককে হতে হয় ক্ষেত্রবিশেষে একেকজন বুদ্ধিজীবী, একেকজন গবেষক। যেকোন ইস্যুর অতল গহবরে পৌঁছে তিনি মূল রহস্যটা উদঘাটন করে জাতির সামনে তুলে ধরেন তার লেখনীর অমীয় শক্তি দিয়ে। অথচ আজকাল দেখা যায় ইস্যু পেলেই তাকে টিস্যু বানিয়ে হুমড়ি খেয়ে কলম চালাতে তৎপর আমাদের কতিপয় সাংবাদিক, আর দেশজুড়ে মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় গুজব ও আতংক; এর জন্য অবশ্য নামসর্বস্ব কিছু নিউজ পোর্টালই বেশি দায়ী, পাশাপাশি দেশে ‘সায়েন্স জার্নালিজম’ চর্চার যে দৈন্যতা তারও একটি ফসল দেশের বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য গবেষণার প্রতি সাধারণ মানুষের আজকের এই অনাস্থা। মূলত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কোন ড্রাগ বা থ্যারাপী স্থূলভাবে ইভ্যালুয়েশন ও কোয়ালিটি এ্যাসুরেন্সে কনফার্মড ভেলিডেশন না পেলে অনুমোদন দেয় না; যেমনটা এখন বিশ্বব্যাপী বহুল পরিচিত আইভারমেক্টিন, ডক্সিসাইক্লিন, ফ্যাভিপিরাভির বা হাইড্রক্সি ক্লুরোকুইনিনের ক্ষেত্রেও, করোনা চিকিৎসায় এই ড্রাগগুলোর অবাধ ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা আছে WHO ‘র। তারপরও অনেক দেশে এখনো এই ওষুধগুলোর প্রয়োগ হচ্ছে নিজ দেশের স্বাস্হ্য বিভাগের অনুমোদনের ভিত্তিতে ইনভেষ্টিগেশনাল ট্রায়াল হিসেবে এবং এটা ইথিক্যালি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ট্রায়ালতো দূর, ক্ষেত্রবিশেষে সাফল্য পাওয়ার তথ্য বা সম্ভাবনা (!) আছে শোনামাত্রই বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ফার্মেসীতে ভীড় লেগে আছে উক্ত ড্রাগগুলোর জন্য; উপসর্গ থাক বা না থাক; করোনা আক্রান্ত হোক বা না হোক দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা না ভেবেই মুড়ির মতো অযাচিতভাবেই গিলে চলেছেন আমাদের অত্যধিক স্বাস্থ্যসচেতন জাতি; আর সুযোগে ড্রাগগুলো স্টক করে মার্কেটে কৃত্রিম সংকট তৈরী করছেন মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট! সে তুলনায় এখন পর্যন্ত একমাত্র ‘প্লাজমা থ্যারাপি বা পরোক্ষ এন্টিবডি থ্যারাপি’ ই সবচেয়ে ঝুঁকিমুক্ত একটা চিকিৎসা পদ্ধতি; যেটা WHO অবাধ ব্যবহারে না’ করলেও কিন্তু ক্লিনিকাল ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছে; একই কথা জানিয়েছে আমেরিকা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান FDA ( ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন) ও। আর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল প্রয়োজনের প্রেক্ষিত লক্ষাধিক মানুষের উপরও করার যায়। তাই শুধুমাত্র আমেরিকাতেই এখন পর্যন্ত ১০,০০০ রোগীর উপর কনভালোসেন্ট প্লাজমা থ্যারাপীর ট্রায়াল চলেছে; চীন, জার্মান, ইতালী সহ অনেক উন্নত দেশই এখন শেষ ভরসা হিসেবে এই ‘পরোক্ষা এন্টিবডি থ্যারাপী তথা প্লাজমা থ্যারাপী’ কে- ই বেঁচে নিচ্ছে এবং আশার কথা হলো এখন পর্যন্ত কোন নেগেটিভ ফীডব্যাকের তথ্য পাওয়া যায়নি! তেমনি এদেশেও শুরু থেকেই স্বাস্থ্য গবেষকগণ বলে আসছেন, এটা কেবলই মুমূর্ষদের জন্য অন্ধেরষষ্ঠী হিসেবে ট্রায়াল হিসেবে দেয়া উচিত, গড়পড়তা সবার জন্য এই পদ্ধতি এখনও গ্রহণযোগ্য কেউই দাবী করেছেন কিনা আমার অন্তত জানা নেই। তবে শুধুমাত্র অত্যধিক চাহিদার কারণে দেশের অনেক জায়গায় ডোনারের ‘এন্টিবডি টাইটার’ টেস্ট না করেই ধারণার ভিত্তিতে প্লাজমা ট্রান্সফিউজ করা হচ্ছে যা হিতে বিপরীত ফলাফল নিয়ে আসতেও পারে; কোন কারণে একজনের দেহে যদি নেগেটিভ ফীডব্যাক দেয় তবে এই বুদ্ধিজীবী জাতি রে রে করে তেড়ে আসবেন আর ‘কান্ট্রি সিস্টেম’ এর গোষ্ঠী উদ্ধার করবেন নিশ্চিত! তাই, প্লাজমা থ্যারাপী যে ১০০% কাজ করবে, সব রোগীকেই বাঁচাতে সক্ষম হবে প্রথমেই আমাদের মস্তিষ্ক থেকে এ ধারণা মুছে ফেলতে হবে; এখন পর্যন্ত যেহেতু খোদ WHO- ও কোন প্রতিকার বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নির্দেশনা দিতে পারেনি তাই জনজীবন বাঁচাতে সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা আমাদের করে যেতে হবে আর তাতে সকলের নীতিগত সমর্থনও জরুরী, জরুরি ব্যক্তি সচেতনতার।
এস. এম. ইকরাম হোসাইন লেখক ও বায়োমেডিকেল গবেষক