দূষণের হাত থেকে হাড়িধোয়া-মেঘনাকে বাঁচাবে কে?
আশিকুর রহমান, নরসিংদী :-নরসিংদীর বিভিন্ন কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্যামিকেল মিশ্রিত পানি এবং পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা সরাসরি নদীতে ফেলার ফলে ভয়াবহ দূষণের শিকার নরসিংদী সদর উপজেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হাড়িধোয়া ও মেঘনা নদীর পানি। মনোহরদী উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম ও শিবপুর উপজেলার পশ্চিম-উত্তর শীতলক্ষা নদীর প্রান্ত থেকে প্রায় ৬০-৭০ কিলোমিটার হাড়িধোয়া নদীটি আঁকাবাঁকা হয়ে জেলা শহরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে এসে মেঘনার নদীর মোহনায় মিলিত হয়েছে। একসময়ে এই নদী পথে ব্যবসা বাণিজ্যসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা ছিল। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বসবাস ছিল। নদীর পানি ব্যবহার হতো কৃষি ও গৃহস্থালির কাজে। বর্তমানে পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা এবং কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য ও ক্যামিকেলে নষ্ট হচ্ছে হাড়িধোয়া ও মেঘনা নদীর পানি। প্রতিনিয়তই বাড়ছে দূষণ। নদীর স্বচ্ছ পানি এখন আলকাতরার মতো কালো রং ধারণ করেছে। একসময় মানুষ নদীর পাড়ে বসে আড্ডা দিত। কিন্তু সেই দিন এখন আর নেই। দূষণের কারণে এলাকায় কৃষিকাজে এই পানি ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফলে পানির অভাবে অনেক জমি কৃষি কাজে ব্যাহত হচ্ছে। এই নদীতে একসময় বড় বড় জাহাজ আর পাল তোলা নৌকা চলতো। নদী পথে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য করতে সহজেই ছুটে আসতেন নরসিংদীতে। ফলে নদীর তীরে গড়ে তুলেন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। এতে করে দিনদিন নদী সংকুচিত হতে থাকে। ফলে বছরের বেশির ভাগ সময়ই নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় নৌকাও চলে না। তাছাড়া কারখানার বর্জ্য মিশে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমেও পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) মাত্রা কম থাকে। এ কারণে এই দুই নদীতে মাছ বাঁচে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সদর উপজেলাটি আড়িয়াল খাঁ, হাড়িধোয়া ও মেঘনা নদী ধারা বেষ্টিত। আড়িয়াল খাঁ ও হাড়িধোয়ার পানি মেঘনা নদীর উপর প্রবাহিত হচ্ছে। নরসিংদী সদর উপজেলার পার্শ্ববর্তী উপজেলা শিবপুরের বড়ইতলা এলাকায় গড়ে ওঠা কয়েকটি শিল্প কারখানা, শিল্পনগরী বিসিক, সদর উপজেলার ঘোড়াদিয়া ব্রীজ, হাজীপুর ব্রীজ ও শহরের বিভিন্ন স্থান দিয়ে পৌরসভার পাইপ ড্রেনের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি কলকারখানার বর্জ্য ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্যামিকেল মিশ্রিত পানি সরাসরি হাড়িধোয়া ও মেঘনা নদীতে পড়ছে। এছাড়া মেঘনা নদীতে সারাসরি শহরের বিভিন্ন শিল্পকারখানা, শিলামান্দী, মহিষেরশুড়া, কাঁঠালিয়া ও মাধবদী এলাকায় গড়ে ওঠা অসংখ্য ড্রাইং এন্ড ফিনিশিংয়ের ক্যামিকেল মিশ্রিত পানি ও বর্জ্য খালের মাধ্যমে সরাসরি ফেলা হচ্ছে মেঘনা নদীতে। এতে করে দিন যত যাচ্ছে খরস্রোতে পরিণত হচ্ছে। নরসিংদী পৌরবাসীদের সুপেয় ও নিরাপদ পানির নিশ্চিত করতে কয়েক বছর আগে শহরের কাউরিয়া পাড়া এলাকায় মেঘনা নদীর পাড়ে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ওয়াটার টিটমেন্ট গড়ে তুলেন। মেঘনা নদীর পানি দূষিত হওয়ায় ওই ওয়াটার টিটমেন্টের পানি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলেও অনেকে মন্তব্য করেন।
শহরের মেঘনা নদীর পাড়ে বসবাসকারী জুয়েল মিয়া বলেন, এখানে আমাদের দীর্ঘদিনের বসবাস। নদীরও যে প্রাণ আছে তা এই মেঘনা নদীকে দেখলে বুঝা যায়। এজসময় এই নদীতে তীব্র স্রোত ছিল। এখানে বড় বড় জাহাজ ভিড়তো। পাথর, পাট সহ হরেকরকমের মালামাল উঠানামা করতো। এখন এগুলো রূপকথার গল্প হয়ে গেছে।
হাজীপুর এলাকার জেলে মজনু মিয়া বলেন, কয়েক বছর আগে হাড়িধোয়া নদীতে জাল বেয়ে মাছ ধরে সংসার চালাতাম। বিভিন্ন জাতের মাছ ধরা হতো। একসময় এ নদী দিয়ে সিলেটের হাওড় অঞ্চল থেকে গয়না নামক নৌকা দিয়ে মালামাল নিয়ে আসতো নরসিংদীর বড় বাজারে। এখন মাছতো দূরের কথা রংয়ের পানিতে নদীই শুকিয়ে গেছে। ফলে এটা মরা নদী হিসেবে পরিচিত। জেলের কাজ বাদ দিয়ে এখন দিনমুজুরের কাজ করি।
কৃষক ইসলাম মিয়া বলেন, একসময় এ অঞ্চলে অনেক শস্য চাষ করা হতো। কিন্তু নদীর পানি দূষণ ও পানির অভাবে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। নজরপুর ও করিমপুর ইউনিয়নের একাধিক কৃষক ও জেলেরা জানান, মেঘনা নদীর দুপাড়ে কয়েক লক্ষ হেক্টর জমি চাষাবাদের জন্য উপযোগী ছিলো। নদীর তীরবর্তী হওয়ায় জমি উর্বর ছিলো। দিন দিন শিল্প কারখানার ক্যামিকেল মিশ্রিত পানি ও বজ্য নদীতে ফেলার কারণে পানি দূষিত হয়ে গেছে। এই পানি এখন আলকাতরার মত হয়ে গেছে। আগে আমরা নদীর পানি দিয়ে রান্না করা থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় কাজ করতাম। এ নদীতে একসময় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছিল। এখন দূষণের কারণে আগের মতো আর মাছ নেই। মিল কারখানান ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বর্জ্য ও ক্যামিকেলের পানি ফেলে দূষিত করছেন নদী। আরও বলেন, নদীর উত্তাল ঢেউ আর স্রোত এখন আর দেখা যায় না। বর্তমানে নদীটি দূষণের ফলে সব ঐতিহ্য হারিয়েছে। আশপাশের বিভিন্ন কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত বর্জ্য ও ক্যামিকেলের পানি প্রতিদিনই নদীতে নামছে। পানির দূর্গন্ধে টিকে থাকা যাচ্ছে না।
পরিবেশ আন্দোলনের একাধিক নেতার সাথে কথা হলে তারা বলেন, পরিবেশ রক্ষায় আইন আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই। তা আজ দৃশ্যমান। সরকার ঘোষিত প্রত্যেক শিল্প কারখানায় ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হলেও তা মানছে না মালিকরা। আর না মানার কারণেই হাড়িধোয়া ও মেঘনা নদী এখন মৃত্যু প্রায়। আমরা বেশ কয়েকবার দূষণ ও দখলমুক্ত করার জন্য নদী রক্ষা আন্দোলন করেছি। তারপরও দূষণমুক্ত রাখতে পারিনি।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর নরসিংদী’র উপপরিচালক কামরুজ্জামান প্রতিনিধিকে জানান, গত কয়েকদিন আগে আমরা জেলা প্রশাসকের সহায়তায় হাড়িধোয়া নদীর দু’পাশ দখলদার হাত থেকে দখল মুক্ত করেছি। পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের সাথে হাড়িধোয়া নদীর পাড়ে ময়লা-আবর্জনা না ফেলার জন্য মতবিনিময় করেছি। নদীর পানি দূষণ রোধে শিল্প কারখানায় ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে এখনও ইটিপি স্থাপন করা হয়নি তাদেরকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইটিপি থাকা সত্ত্বেও চালু না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরকম হওয়ার সুযোগ নেই। যারা এমন কাজ করছে তাদেরকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রত্যেক ইটিপিকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হচ্ছে। ফলে ইচ্ছা করলেই ইটিপি বন্ধ রাখতে পারবেনা। প্রতিনিয়ত অভিযানের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে তা করতে পারছি না। এছাড়াও আমার পরিধি যতটুকু আমি ততটুকুই করতে পারবো। এর বেশিকিছু করতে পারি না।
স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলে হাড়িধোয়া ও মেঘনা নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে পারে বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবাদীরা এমনটা মনে করেন