নেত্রকোনায় সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে নারিকেলের ফেলে দেওয়া ছোবড়া
সোহেল খান দূর্জয়,নেত্রকোনা : নেত্রকোনায় সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে নারিকেলের ফেলে দেওয়া ছোবড়া। নেত্রকোনা থেকে বাদ দেওয়া নারিকেলের ছোবড়া থেকে উৎপাদিত আঁশ ও গুঁড়া বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। নেত্রকোনায় সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে ছোবড়া শিল্প। সম্প্রতি কয়েক দিন মাঠে ঘুরে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এই সম্ভাবনাময় শিল্পের বিষয়ে। একইসঙ্গে বিকল্প আয়ের পথ তৈরি হচ্ছে। ছোবড়া থেকে আঁশ ছাড়ানোর সময় বের হওয়া গুঁড়া বস্তায় ভরে একপাশে স্তূপ করা হচ্ছে। মোহনগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকজন জানান, একসময় নারিকেলের ছোবড়া শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে বর্ষায় ছোবড়া শুকাতে অসুবিধা বলে তা ফেলে দেওয়া হতো। এই অঞ্চলে একসময় প্রচুর নারিকেল উৎপাদিত হতো। আলিম নামে এক ব্যক্তি বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে নারিকেলের ছোবড়া সংগ্রহ করা হয়। তোশকের ভেতরের অংশ তৈরি হয় মূলত নারিকেলের ফেলে দেওয়া ছোবড়ার আঁশ দিয়ে। নারিকেলের ছোবড়া থেকে আঁশ ছাড়াতে গেলে প্রচুর পরিমাণে গুঁড়া বের হয়। কৃষিকাজে বিশেষ করে ফুল চাষে এই গুঁড়ার আছে ব্যাপক চাহিদা। সুমন নামে এক ব্যক্তি জানান, ১ হাজার নারিকেলের ছোবড়ায় ১৬০ থেকে ১৮০ কেজি আঁশ পাওয়া যায়। একই সঙ্গে ফেলনা উপজাত হিসেবে বের হয় ১২ কেজির মতো গুঁড়া। বর্তমানে একটি ছোবড়ার দাম চার থেকে পাঁচ টাকা। প্রতি কেজি আঁশ ৩০ থেকে ৩২ টাকা এবং প্রতি বস্তা (ছয় কেজির বস্তা) গুঁড়া ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হয়। নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন লেপ-তোশকের দোকানে এসব আঁশ বিক্রি হয়।
নেত্রকোনা শহরের মো. আলামিন বলেন, খরচ বাদ দিয়ে সব মিলিয়ে মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার থাকে; কিন্তু বেশ কিছুদিন গ্রামীণ এলাকায় ছোবড়ার সংকট দেখা দেওয়ায় কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তবে এটা সম্ভাবনাময় শিল্প। এই শিল্পে সরকারি সহায়তা পেলে সমৃদ্ধি ঘটবে। গত কয়েক বছর আগেও নারিকেল ছোবড়া তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে আসত না। অনেকে এগুলো ফেলে দিত। আবার কেউ কেউ শুধুমাত্র জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করত। কিন্তু এক সময়ের ফেলনা নারিকেলের ছোবড়া এখন অনেক দামি। শুধুমাত্র প্রক্রিয়াজাত করে বছরে অনেক টাকার বাণিজ্য হয় ফেলে দেওয়া এ নারিকেলের ছোবড়া থেকে। এমনটা জানিয়েছেন নেত্রকোনা ছোবড়া ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, নারিকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি হয় ‘কোকো ফাইবার’। যা দিয়ে সোফার সিট ও জাজিম তৈরি করা হয়। নেত্রকোনায় সেলিম নামে এক ব্যক্তি জানান, গত ১০ বছর ধরে নারিকেলের ছোবড়ার আঁশ দিয়ে জাজিম, পাপোস, দঁড়ি, সোফা ও চেয়ারের গদিসহ বিভিন্ন ধরনের সৌখিন ও প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করা হয়। বেডিং শিল্পেও ছোবড়ার ব্যবহার। আর ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরির সময় যে গুড়া পাওয়া যেতো তা কোনো কাজে লাগতো না। কিন্তু এখন কোকো ফাইবার নামে ছোবড়ার আঁশ এবং কোকোডাস্ট নামে ছোবড়ার গুঁড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
নেত্রকোনা শহরের মাছুয়া বাজারের নারিকেল ব্যবসায়ী আবদুর রহিম জানান, প্রতিটি কারখানায় প্রতিদিন কয়েক টন ছোবড়াকে আঁশে পরিণত করা হয়। ব্যাপক চাহিদা থাকায় জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতি বছর ছোবড়া প্রক্রিয়াজাত করণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছোবড়া থেকে মেশিনের সাহায্যে বের করা হয় আঁশ বা ফাইবার। এক হাজার নারিকেলের ছোবড়ায় কমপক্ষে ৮০ কেজি আঁশ পাওয়া যায়। নেত্রকোনার লক্ষীগঞ্জ এলাকার তোফায়েল জানান, গত দুই বছর আগেও প্রতিটি নারিকেলের ছোবড়া কেনা হতো ৫০ পয়সা দরে। এখন মান ভেদে প্রতিটি নারিকেলের ছোবড়া পাঁচ-সাত টাকায় কেনা হয়। ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরির পর প্রতি ২০ কেজি ওজনের একেকটি ফাইবার বান্ডেল বিক্রি করা হয় ৫০০-৬০০ টাকা দরে। আমার জানা সত্বে প্রতিটি কারখানায় সপ্তাহে চার-ছয় ট্রাক ফাইবার উৎপাদন হয়। প্রতি ট্রাকে কমপক্ষে ২০০ বান্ডেল ফাইবার বহন করা হয়। তিনি জানান, সব খরচ বাদে একেকটি ব্যবসায়ীর মাসে অন্তত ৫০ হাজার টাকা আয় হয়।মো. জাকির হোসেন বলেন, আমরা ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরি করি। আমাদের থেকে ফাইবার নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানি তোশকের ভেতরের অংশ, ম্যাট্রেস বা কয়ার ফেল্ট তৈরি করে। সে কারণে বর্তমানে ছোবড়ার আঁশ বা ফাইবারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান জানায়, জেলায় প্রায় দুই হাজার ৭৩৫ হেক্টর জমিতে নারিকেল গাছ রয়েছে। এছাড়া প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনাতেই রয়েছে অনেক নারিকেল গাছ। বিভিন্ন বাড়ি থেকে বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় কোটি শুকনো নারিকেল আহরণ করা হয়। এবিষয়ে জানতে চাইলে নেত্রকোনা বিসিক শিল্প নগরীর উপব্যবস্থাপক (ভঃ) শিরিন ইসলাম বলেন, নারিকেলের ফেলনা ছোবড়া প্রক্রিয়া করতে নেত্রকোনায় অনেকগুলো অস্থায়ী কারখানা গড়ে উঠেছে। এতে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। অপ্রচলিত এ পণ্যের ব্যাপক বাজার তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এ জেলায়।এর পাশাপাশি অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।