নেত্রকোনা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে নারিকেল ও সুপারী গাছ

Share the post
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : প্রচণ্ড খরা, অনাবৃষ্টি ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে নেত্রকোনা অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নারিকেল ও সুপারী গাছের বাদা (ফলের দানা)। বাড়ির আঙ্গিনায়, উঠানের ধারে, জমির আইলে সারিবদ্ধ নারিকেল গাছ সৌন্দর্যের যেমন শোভা পেত তেমনই দিত সুস্বাদু ফল। কিন্তু কালের বিবর্তনে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ও ফারাক্কার মরণবাঁধে নেত্রকোনাসহ আশে পাশে এলাকায় অতিরিক্ত খরা ও পানি শূন্যতায় বিলুপ্ত হতে বসেছে এই নারিকেল ও সুপারী গাছ। জানা যায়, নারিকেল অতিব সুস্বাদু ফল, সুপারী নেত্রকোনায় গ্রাম-বাংলার অতিথি আপ্যায়নে অতি সাধারণ একটি নিয়ম ছিল। গ্রাম অঞ্চলে একজনের বাড়িতে আরেক প্রতিবেশী আসলে তাকে পান-সুপারী দিয়ে আপ্যায়ন করা হত। কিন্তু যেভাবে সুপারীর দাম দিন দিন বেড়ে চলেছে তাতে গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষ আর পান-সুপারী কিনে খাওয়া সম্ভব হবে না।
নেত্রকোনা পৌর শহরের মাছুয়া বাজারে গিয়ে পান-সুপারীর দোকানে দেখা গেছে, ১টি সুপারী দাম হাকা হচ্ছে ১০ টাকা। ১ টি সুপারী কেটে ৫ বার পান খাওয়া যায় একজন লোকের তাহলে মধ্যবৃত্তরা কিভাবে পান-সুপারী খাবে। অপর দিকে ডাব পুষ্ট হয়ে নারিকেলে পরিণত হয়। ডাবে প্রচুর পরিমাণ পটাসিয়ামসহ ঔষধি গুণ রয়েছে। তৃষ্ণা মিটাতে ডাবের বিকল্প আর কিছুই নেই। সব মিলে নেত্রকোনায় ডাব-নারিকেলের বিশেষ কদর। বিগত দশকে নারিকেল গাছগুলো সবল থেকে বেশি ফল দিত। বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তনে গাছগুলো ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ ও দুর্বল হয়ে পড়ছে। গাছগুলোর দুর্বলতার কারণে ফল ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। পূর্বে নারিকেল ও সুপারী গাছে বার মাসই ডাব-নারিকেল, সুপারী পাওয়া যেত। বর্তমানে বর্ষা মৌসুম ছাড়া তেমনটি ডাব চোখে মিলে না। আগের দিনে প্রতিটি এলাকায় সারিবদ্ধভাবে নারিকেল ও সুপারী গাছ লাগানো ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে গাছ মরে যাবার প্রবণতায় সারিবদ্দ নারিকেল ও সুপারী বাগান আর তেমন নেই। দু’ একটি বাগান থাকলেও তাতে জলবায়ুর প্রভাবে গাছগুলো ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। এই কারণে নেত্রকোনায় প্রতিটি এলাকায় অতিরিক্ত খরা ও অনাবৃষ্টির প্রভাব পড়ছে। আবহাওয়ার পরিবর্তন ও ফারাক্কা বাঁধের কারণে জেলার প্রতিটি এলাকার নদ-নদীতে তেমন পানি থাকছে না। গত কয়েক বছর ধরে বৃষ্টির পরিমাণ কমতে কমতে গত দু’বছর থেকে প্রায় তেমন কোনো বৃষ্টি নেই বললেই চলে। নেত্রকোনা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে,জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। এবার দেশের অন্যান্য এলাকায় বৃষ্টি বন্যা হলেও এই এলাকায় আষাঢ়ের শেষে ভাদ্র মাসেও তেমন বৃষ্টি মিলেনি। সেচ পাম্প দিয়ে ফসলী জমিতে অনেকেই পানি দিয়েছে। কিন্তু তেমন কোনো সুযোগ ছিল না বাড়ির আঙ্গিনায় কিংবা বাড়ির পতিত জমিতে সেচ ব্যবস্থার। এতে করে বৃষ্টির অভাব অতিরিক্ত খরা ও পানি শূন্যতায় বেশিরভাগ নারিকেল ও সুপারী গাছগুলো শুকিয়ে মারা গেছে। এই এলাকায় কোনো সময় নারিকেল গাছ বর্ষায় কিছুটা তরতাজা হলেও পরপর পানির অভাবে গাছগুলো নুয়ে পড়ে। নারিকেল ও সুপারী গাছ অতিরিক্ত খরায় রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। শীতের সময় ঘনকুয়াশা আর গ্রীষ্মের খরায় নারিকেল ও সুপারী গাছ রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে নেত্রকোনা শহরের সুপারী ও নারিকেল এবং ডাব বিক্রেতা কপিল উদ্দিন জানান, এক সময় গ্রামে সারিবদ্ধ নারিকেল ও সুপারী গাছ ছিল। তাতে প্রচুর সুপারী এবং ডাব ও নারিকেল পাওয়া যেত। গত কয়েক বছর ধরে অতিরিক্ত খরায় গাছগুলো শুকিয়ে মারা যেতে শুরু করে। আর যেগুলো এখন রয়েছে তা ক্ষীণ তাতে ডাব ও সুপারী তেমন ধরে না, ধরলেও তা ফল হয়ার আগেই ঝরে পড়ে। তিনি আরো জানান, ‘৫ বছর আগেও সুপারী বিক্রি করে বাজার সদাই করে চলতাম। কিন্ত এখন আমি নিজেই নারকেল, সুপারী কিনে খাই। ১ গা (১০টা) সুপারী দাম অহন বাজারে ১শ’ টাহা। আমরা কিভাবে বাপ-দাদার পুরানা অভ্যাস বদলামু।’
কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতী ইউনিয়নের পাঁচগাও গ্রামের আজাহার উদ্দিন জানান, ‘আগে খাল, বিল ও নদীতে প্রচুর পানি থাকত আবহাওয়া নরম ছিল। বর্তমানে অতিরিক্ত খরা ও অনাবৃষ্টির কারণে নারিকেল ও সুপারী গাছ নীচ থেকে পানি টানতে পারছে না। এতে করে আমাদের এলাকায় নারিকেল ও সুপারী গাছ লাগানোর আগ্রহ হ্রাস পেয়েছে।’নারিকেল ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন জানান, অতিরিক্ত খরায় এলাকা মরুভূমিতে রূপ নিয়েছে। বিগত দীর্ঘদিনের খরা ও অনাবৃষ্টিতে নারিকেল গাছগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে এবারে তুলনামূলক বানবর্ষা না হলেও কয়েকবার বৃষ্টিতে গাছগুলোর চেহারার পরিবর্তনসহ ডাবের কড়ি, সুপারীর বাদা দেখা দিয়েছে। কিন্তু ইদুরের উৎপাতে সেগুলো থাকবে না। নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান জানান, জলবায়ুর পরিবর্তন এর ফলে এবার সুপারী ও নারিকেল গাছে থাকে না। এর প্রভাব পড়েছে বর্তমান বাজারে। টাকা দিয়াও বাজারে তেমন নারিকেল ও সুপারী পাওয়া যাচ্ছে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

নেত্রকোনায় বাপ দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চায় শীতল পাটির কারিগররা

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : শীতল পাটি বাংলার সুপ্রাচীন এক কুটির শিল্পের নাম। শীতল পাটি আমাদের সভ্যতা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের অংশ। এছাড়া বাংলাদেশের শীতল পাটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যেরও অংশ। জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিক এ স্বীকৃতি ঘোষণা দেয়। এক সময় সারাবিশ্বে ছিল শীতল পাটির খ্যাতি। আমাদের গৃহস্থালির নানা দরকারি জিনিসের […]

নেত্রকোনায় বন্যায় সাড়ে ৩শ কোটি টাকার আমন ফসলের ক্ষতি, অন্যদিকে ছয়শ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক ডুবে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : নেত্রকোনায় টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর আমন ফসলের জমি নষ্ট হয়েছে। যেখানে উৎপাদিত ধানের মূল্য সাড়ে ৩শ কোটি টাকা। এই বন্যায় নষ্ট হয়েছে নানা জাতের সবজি খেত। চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকরা। কিছু অঞ্চলে পানি নামলেও নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে ভাটি এলাকার […]