নেত্রকোনায় আদা চাষে স্বাবলম্বী সফল নারী উদ্যোক্তা নাসিমা আক্তার

Share the post
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : কিশোর বেলায় দুই চোখ ভর্তি স্বপ্ন ছিল। বিয়ের পর সন্তান-সন্ততিসহ একটি সাজানো সংসারে সুখে বসবাস করার স্বপ্ন যেন চোখ উপচে পড়তে চাইত। কিন্তু সে সুখ তার কপালে জোটেনি। বিয়ের কিছু দিন পর পারিবারিক কারণে বরের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। তিন সন্তান শ্বশুরবাড়ি রেখে বাবার বাড়ি ফেরেন নাসিমা আক্তার। কিন্তু জন্মের পর যে বাড়িতে নারীর নাড়ি পুঁতে রাখে স্বজন, যে ঘরে মেয়েরা বড় হয় বিয়ে বিচ্ছেদের পর সে বাড়িঘর আপন করে পেতে খুব বেগ পেতে হয় তাকে। তবুও ঠিকানা তো একটা থাকতে হয়, থাকতে হয় ঘর, যেখানে জীবনের সমস্ত না পাওয়া নিয়েও ফেরা যায়। বাবার বাড়িকেই প্রকৃত ঠিকানা মেনে নিজ ভাগ্যোন্নয়নে মন দেন তিনি। এ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় একা ছিলেন, যখন ফিরলেন নিজের তিন অস্তিত্ব ভিন্নখানে রেখে তাকে ফিরতে হয়েছে। বলছিলাম, নেত্রকোনা সদর উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের তিয়স্ত্রী গ্রামের নাসিমা আক্তারের (২৬) কথা। গরিব বাবার বাড়ি এসে অন্যের বোঝা হয়ে থাকতে চাননি তিনি। শুরু হয় তার একা বেঁচে থাকার লড়াই। কাজের উদ্দেশ্যে চলে যান ঢাকায়। সেখানে একটি ক্লিনিকে প্রায় চার বছর কাজ করেন। সেখান থেকেই ইউটিউবসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিও দেখে একান্ত নিজস্ব কিছু করার চিন্তা করেন। তারপর থেকে তার বাবার বাড়ি এসে শুরু করেন আদা চাষ। বাবার পরিত্যক্ত জায়গায় অল্প পরিসরে ছোট ছোট প্লাস্টিক বস্তায় আদার বীজ রোপণ করে ভালো ফলন পান তিনি। এরপর বড় পরিসরে শুরু করেন আদা চাষ।
ঢাকায় ক্লিনিকে চাকরি করার সময় ইউটিউবসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ভিডিও দেখে আগ্রহী হয়ে ওঠেন নাসিমা আক্তার। ২০২২ সালে বাবার বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত জমিতে অল্প পরিসরে আদা চাষ শুরু করেন। ভালো ফলন হয়। এ বছরও বড় পরিসরে ৫০ শতাংশ জমিতে আদা চাষ করেন। এতে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ বস্তায় আদা চাষ করি। আগের বছরের মতোই ফলনও হয়েছে ভালো। অল্প খরচে কম পরিশ্রমে এখানে আদা চাষ দেখে আগ্রহী হয়ে উঠছেন গ্রামের অনেকেই। তার সাফল্যে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় কৃষি বিভাগও। নাসিমার আগ্রহ দেখে প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে এবং পরামর্শ দিয়ে নিয়মিত পাশে থাকছে স্থানীয় কৃষি বিভাগের সবাই। মেয়ের আগ্রহে বাদ সাধেননি নাসিমার বাবা লালু মিয়া। মেয়ের প্রয়োজনে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আগলে রাখেন মেয়েকে। একই গ্রামের রুবেল মিয়া নাসিমার দেখাদেখি বাড়ির পাশে কিছু বস্তায় আদা চাষ শুরু করেন। এ বছর ভালো ফলন পেলে আগামীতে আরও বেশি করে আদা চাষ করবেন। এ ছাড়াও এলাকার কৃষকসহ সাধারণ মানুষ অনেকেই তাদের বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত জমিতে গাছের ছায়ায় আদা চাষ শুরু করেছেন।
কৃষি উদ্যোক্তা নাসিমা আরও বলেন, ‘আমাদের গ্রামের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে কর্মজীবী নারী-পুরুষ রয়েছে। তবে কৃষি কাজে কেউ এগিয়ে আসতে চায়না, ভয় পায়। আমাদের চারপাশে অনেক পতিত জমি রয়েছে। কোনো জমি অনাবাদি না রেখে ফসল ফলাতে হবে। আমি চাই, নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই যেন কৃষিকাজে এগিয়ে আসে এবং কাজ করে। তা হলে আমরা এলাকার সামগ্রিক চাহিদা মিটিয়ে অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হব।’ ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে আদা চাষ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি। সদর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা তানজিনা রহমান নিসা বলেন, বর্তমানে নাসিমার জমির গাছগুলো মোটামুটি ভালো হয়েছে। আমরা আশা করছি ভালো ফলন হবে। কৃষি অফিস থেকে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে। নাসিমার পিতা লালু মিয়া বলেন, বিয়ের পর বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যায় পড়ে আমার মেয়ের বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকে আমার কাছেই আছে। আমার রোজগার কম থাকায় মেয়েও চেষ্টা করছে নিজে রোজগার করার। বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত কিছু জায়গা আছে, সেখানে সে আদার চাষ করেছে। আমিও সময় পেলে তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। সে নিজে স্বাবলম্বী হোক এটাই আমি চাই। নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, পতিত জমিতে নাসিমার আদা চাষে আগ্রহ দেখে খুব ভালো লেগেছে। নারীর হাতেই কৃষির সূচনা। তাই তার এই কৃষি কাজে মনোনিবেশের প্রবণতা খুবই ভালো উদ্যোগ। নাসিমার আগ্রহ দেখে কৃষি অফিস থেকে কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি করার সরঞ্জাম সরবরাহ করে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

নেত্রকোনায় বাপ দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চায় শীতল পাটির কারিগররা

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : শীতল পাটি বাংলার সুপ্রাচীন এক কুটির শিল্পের নাম। শীতল পাটি আমাদের সভ্যতা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের অংশ। এছাড়া বাংলাদেশের শীতল পাটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যেরও অংশ। জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিক এ স্বীকৃতি ঘোষণা দেয়। এক সময় সারাবিশ্বে ছিল শীতল পাটির খ্যাতি। আমাদের গৃহস্থালির নানা দরকারি জিনিসের […]

নেত্রকোনায় বন্যায় সাড়ে ৩শ কোটি টাকার আমন ফসলের ক্ষতি, অন্যদিকে ছয়শ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক ডুবে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : নেত্রকোনায় টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর আমন ফসলের জমি নষ্ট হয়েছে। যেখানে উৎপাদিত ধানের মূল্য সাড়ে ৩শ কোটি টাকা। এই বন্যায় নষ্ট হয়েছে নানা জাতের সবজি খেত। চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকরা। কিছু অঞ্চলে পানি নামলেও নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে ভাটি এলাকার […]