নেত্রকোনায় চিকিৎসকদের লাগামছাড়া ভিজিট, অসহায় রোগীর স্বজনরা

Share the post
সোহেল খান দূর্জয়,নেত্রকোনা : প্রসূতি ও গাইনী চিকিৎসা করেন ডা. আব্দুল কাইয়ুম। রোগী দেখেন নেত্রকোনা শহরের বেশ কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ও হাসপাতালে। নতুন রোগীর কাছ থেকে ফি (ভিজিট) নেন ৮০০ টাকা। একই রোগী দ্বিতীয়বার দেখাতে গেলে নেন ৫০০ টাকা। সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সাহতা ইউনিয়নের ডেমুরা গ্রামের গৃহবধূ মোমেনা আক্তার খুঁজছিলেন গাইনি ডাক্তার। পরিচিত একজনের কাছ থেকে ডাঃ আব্দুল কাইয়ুমের নাম শুনে তাঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার জন্য খোঁজখবর নেন। কিন্তু ভিজিট শুনেই খেপে ওঠেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এটা কী করে সম্ভব, ভিজিটেই যদি ৮০০ টাকা দিতে হয় তবে এই ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাব কিভাবে? বাংলাদেশে অন্য কোনো গাইনি ডাক্তারের এত টাকা ভিজিট আছে বলে তো শুনিনি। এই ডাক্তার কি শুধু বড়লোকদের চিকিৎসা করবেন? গরিব রোগীদের কি তাঁর সেবা পাওয়ার অধিকার নেই। ভিজিটের দিক থেকে ডাঃ আব্দুল কাইয়ুমকেও ছাড়িয়ে গেছেন আরেকটি একটি বেসরকারি হাসপাতালের অর্থপেডিকস বিশেষজ্ঞ ডা. এম আলী। প্রথমবার রোগীর কাছ থেকে তিনি ভিজিট নেন এক হাজার টাকা।
এদিকে রোগী দেখেন স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এ কে এম সাদিকুল আজম। প্রথমবার তিনি ভিজিট নেন এক হাজার টাকা। দ্বিতীয়বার দেখাতে গেলে নেন ৭০০ টাকা। আর রিপোর্ট দেখতে নেন ৩০০ টাকা। তাঁর কাছে চিকিৎসা নেওয়া শাহজাহান আলম বলেন, ‘দেশের বাইরে অনেক জায়গায় চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু এখানকার মতো ভিজিট নিয়ে চিকিৎসকদের এমন বেপরোয়া বাণিজ্য পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। এখানকার ডাক্তাররা ইচ্ছামতো ভিজিট নির্ধারণ করেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর যেন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এভাবে একই রোগের চিকিৎসার জন্য একেক ডাক্তার একেক রকম ভিজিট নেওয়ায় মানুষের হয়রানির সীমা থাকে না। শাহজাহান আলম নামে এক ব্যক্তি বলেন, ভারতেও ৫০০ রুপির ওপরে ফি নেন না ডাক্তাররা। সরকার সেখানে ডাক্তারদের ভিজিটের বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো সরকারের আমলেই এদিকে নজর দেওয়া হয়নি। সর্বোচ্চ ভিজিট কত হবে আর সর্বনিম্নি কত হবে সে বিষয়ে কোনো নজরদারি নেই। সেই সুযোগে ডাক্তাররাও নিজেদের মতো করে ভিজিট নির্ধারণ করছেন। তিনি আরও বলেন, আমি অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি জানাই এই বিষয়ে নজর দেওয়ার জন্য।
অন্যদিকে নেত্রকোনার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কোথাও কোনো ডাক্তারের ভিজিটেই এখন ৫০০ টাকার নিচে নেই। বরং ৫০০ থেকে শুরু করে যে যাঁর মতো ইচ্ছা বেশি ভিজিট নিচ্ছেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তাঁদের প্রশ্রয় দেয়। জনস্বার্থ নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডাক্তাররা মানুষের সেবা দিলেও সেবার নামে বেপরোয়াভাবে মানুষের টাকা কেড়ে নিচ্ছেন। বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ ডাক্তারই এখন এক হাজার টাকা করে ভিজিট নেন। তাঁরা প্রতিদিন রোগী দেখেন ৪০-৫০ জন করে। কেউ কেউ অবশ্য আরো বেশি রোগী দেখেন, বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁদের চেম্বারের বাইরে সিরিয়াল দিয়ে বসে থাকে রোগীরা। ফলে দিনে কেবল রোগীর ফি থেকেই তাঁদের আয় হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা। এর বাইরে ল্যাবরেটরি-প্যাথলজি-ওষুধ কম্পানি ও হাসপাতালসহ নানা উৎস থেকে আসে আরো কয়েক হাজার টাকা। টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে অনেক সময় তাদের নীতি-নৈতিকতার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চিকিৎসকদের এই প্রবণতা বন্ধ করা না গেলে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় সেবাব্রত বা মানবিকতা বলে কিছুই থাকবে না। সংশ্লিষ্টরা জানায়, নেত্রকোনায় এখন পর্যন্ত ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে আইন, নীতিমালা বা গাইডলাইনও নেই। একবার ডাক্তারদের ফি নির্ধারণে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে আর তা এগোয়নি।
নেত্রকোনার নাগরিক আন্দোলনের নেতাকর্মীরা বলেন, সত্যিই যেন এখন বেশির ভাগ ডাক্তার একরকম টাকার মেশিন হয়ে উঠছেন, যা নীতিহীন ও অন্যায়। এতে রোগীরা কেবল হয়রানির শিকারই হচ্ছে না, চিকিৎসা করাতে এসে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারও দায় এড়াতে পারে না। কারণ নাগরিকসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। ডাক্তারদের ভিজিট ও কমিশন নিয়ে যে প্রকাশ্য বাণিজ্য চলছে তা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এ বিষয়ে অনেকেই বলেন, ডাক্তারের ফি নিয়ন্ত্রণে এর আগে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ফলপ্রসূ করা যায়নি। তা ছাড়া অন্য পেশাজীবীরাও যে যার মতো ফি নিচ্ছেন। তাই কেবল ডাক্তারদের ফি নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলে সেটা পেশাগত বৈষম্য তৈরি করতে পারে।নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ ডাঃ জোবাইদুল হক বলেন, ‘তবে আমরা ডাক্তাররা যেহেতু অন্য যেকোনো পেশাজীবীদের চেয়ে আলাদা বা মানুষের জীবন-মরণের সেবামূলক ব্রত নিয়ে এ পেশায় এসেছি, তাই এ ক্ষেত্রে নিজেদেরই আরো সচেতন ও নীতি-আদর্শ মেনে চলা উচিত। আমরা অনেক সময় দেখি বা শুনি গুরুজনরা যে হারে ফি নেন, নতুন প্রজন্মের অনেকে প্র্যাকটিস শুরু করেই সেই হারে ফি নেওয়া শুরু করেন। এটা কিন্তু আমরা মানতে পারি না। এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট প্র্যাকটিশনারদের জন্য আলাদা নীতিমালা হলে তা শৃঙ্খলা ফেরাতে সহায়ক হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নেত্রকোনা ডেপুটি সিভিল সার্জন ফয়সল আহমেদ বলেন, দেশে এখন পর্যন্ত ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে কোনো ফি নির্ধারণ হয়নি। এ ক্ষেত্রে আইন বা নীতিও নেই; নেই কোনো গাইডলাইন। বহু আগে একবার ডাক্তারদের ফি নির্ধারণে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আর এগোয়নি। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার ডাক্তারের জন্য কোনো ফি নির্ধারণ না থাকলেও এটা নিশ্চিত যে বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে ফি কম নেওয়া হয়।
নেত্রকোনা সিভিল সার্জন ডাঃ অনুপম ভট্টাচার্য্য বলেন, সাধারণত অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসকরা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ফি নেন, আর নিচের পদের চিকিৎসকরা নেন ৫০০ টাকা করে। এর ওপরে কেউ যদি নিয়ে থাকেন, তা আমার জানা নেই। কেউ এ রকম ফি নিলে তাঁদের কাছে যাতে রোগীরা না যায় আমরা সেই অনুরোধ করব। কারণ, আমরা ব্যবসা করতে এ পেশায় আসিনি, এসেছি মানুষের সেবা করতে। এ কাজের বিনিময়ে ন্যূনতম সম্মানী নেওয়াই উচিত। এ জন্য আমরা চাই সরকার প্রয়োজনে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এসব ক্ষেত্রে আরো শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুক। তিনি আরো বলেন, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের জন্য প্রস্তাবিত নতুন একটি আইনের খসড়ায় চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণে কাঠামো তৈরির কথা বলা হয়েছে। আশা করা যায় নতুন আইন হলে ফি নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

শ্রী শ্রী বাসুদেব অনাথ আশ্রমে শ্রীমৎ স্বামী বাসুদেবানন্দ গিরি মহারাজের শুভাবির্ভাব উৎসব

Share the post

Share the post মিলন বৈদ্য শুভ, হাটহাজারী, চট্রগ্রাম : হাটহাজারী নন্দীরহাট নেহালপুর শ্রী শ্রী বাসুদেব যোগাশ্রমে যোগাচার্য পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য শ্রীমৎ স্বামী বাসুদেবানন্দ গিরি মহারাজের শুভাবির্ভাব উৎসব উপলক্ষে গৌর দোল পূর্ণিমা তিথিতে দুই দিনব্যাপী বিশ্বশান্তি গীতাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৩ ও ১৪ মার্চ আয়োজিত এই মহতী ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশ্বশান্তি গীতাযজ্ঞ, মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, গুরুপূজা, বিশ্বশান্তি প্রার্থনা, মনোজ্ঞ […]

তেঁতুলিয়ায় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী টিসিবি’র পণ্য বিতরণ করছেন না টিসিবি ডিলারগণ

Share the post

Share the postপঞ্চগড় প্রতিনিধিঃ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ক্যালেন্ডার অনুযায়ী টিসিবি পণ্য বিতরণ করছেননা কতিপয় টিসিবি ডিলারগণ। সময়মত টিসিবি পণ্য না পেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে কার্ডধারীদের। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) তেঁতুলিয়া উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে খোঁজখবর নিলে এমন তথ্য পাওয়া যায়। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় ও উপজেলা […]