যার গুমের খবরে জিডি নেননি ওসি, তিনি এখন সরকারের উপদেষ্টা
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সবুজ ভূইয়া। পেয়েছেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এখন তাকে নিয়ে এলাকা ও দেশের অগ্রগতিতে স্বপ্ন দেখছে কুমিল্লা জেলাবাসী।জানা যায়, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকবপুর গ্রামের মো. বিল্লাল হোসেন ও রোকসানা আক্তার দম্পতির সন্তান আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া। বাবা বিল্লাল হোসেন স্থানীয় আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভূঁঞা পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং রোকসানা আক্তার একজন গৃহিণী। পরিবারে ৪ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে আসিফ মাহমুদ তৃতীয় সন্তান। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত বৃহস্পতিবার অন্তবর্তী সরকারে স্থান করে নেন আসিফ মাহমুদ সজিব। এমন খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে তাদের বাড়িতে ছুটে আসেন অনেকেই।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পশ্চিম ভিটিতে পূর্বমুখী টিনসেড ঘরটি আসিফ মাহমুদের বাড়ি। বাড়িতে গিয়ে কথা হয় আসিফ মাহমুদের ছোট বোন ইফাত জাহান লামিয়ার সঙ্গে। লামিয়া জানায়, তার বড় ভাই আসিফ ছোটবেলা থেকে খুব মেধাবী। বাবার চাকরির সুবাদে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরে নিজের গ্রামে আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভূঞা পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর ঢাকায় চলে যান। ঢাকার তেজগাঁও হোসেন আলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। তারপর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এখন তিনি স্নাতকোত্তরের ছাত্র।
আন্দোলন চলাকালীন সময়ের ঘটনার বর্ণনা দিতে কেঁদে ফেলেন লামিয়া। তিনি বলেন, ‘ডিবি কার্যালয়ে যে খাবারের ছবি দেয়া হয়েছিল। সে খাবার কি আমার ভাইসহ ছয়জনকে দেয়া হয়েছিল? দেয় নাই। সেখানে গিয়ে আমার ভাইয়ের জ্বর উঠে গিয়েছিল। সরকার পতনের আগের দিন রাত একটার দিকে মামার বাসা থেকে আমার ভাই জোর করে বের হয়ে গিয়েছিল। ওইখানে থাকলে আন্দোলনে যেতে পারবে না এবং বাহির হতে পারবে না। এজন্য রাতেই বের হয়েছিল। এরপর কোথায় ছিল, তা আমাদেরকে বলে নাই’
‘ওইদিন রাতে আমরা কেউই ঘুমাই নাই। আমরা সবাই বাসায় থেকে কান্না করতাম। আম্মু সারারাত নফল নামাজ আদায় করেছিল। ওই রাত্রির পর পরদিন সরকার পতন হবে, সেটা আমরা ভাবি নাই। সরকার কী করে তা নিয়ে একপ্রকার উৎকণ্ঠায় ছিলাম। আমরা ভাবি নাই, সরকার এতো তাড়াতাড়ি পালাই (পালিয়ে) যাবে। যখন শুনলাম সরকার পালাইছে, প্রথমে বিশ্বাস করি নাই। আমার কাছে গুজব মনে হয়েছিল। পরে টিভিতে দেখে বিশ্বাস করছি। আজকে যদি উপদেষ্টার দায়িত্ব নাও পেতো, তাও আমি খুশী ছিলাম। কারণ দেশ তো স্বাধীন করছে- এটাই আমার কাছে বেশী। ছোট বেলা থেকেই আমার ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল, দেশের জন্য কিছু একটা করবেই। ডিবি কার্যালয়ে গুম করে রেখে এত নির্যাতনের পরও আমার ভাই পেছনে ফিরে নাই- এটা আমার জন্য বেশী গর্বের।
আসিফ মাহমুদের বাবা মো. বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথমদিকে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার পর জানতে পারি আসিফ আন্দোলনের সমন্বয়ক। তখন আসিফ মাহমুদকে বাড়ি ফিরে আসতে অনুরোধ করি। পরিবারের সদস্যদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে আসিফ বলেন, ‘আমার অনেক ভাই-বোন পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছেন। আমি আন্দোলন থেকে ফিরে আসব না। হয় গুলি খেয়ে মরবো, না হয় আন্দোলন সফল করে ঘরে ফিরব।’ এরপর থেকেই আমাদের পরিবারে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা শুরু হয়। পাঁচদিন নিখোঁজের সময় আসিফের মা-বোনসহ পরিবারের সবার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। বন্ধ থাকে সবার খাওয়া-দাওয়া। আন্দোলন সফল হওয়ায় অনেক ভালো লাগছে। আমরা চাই এমন খুনি, ফ্যাসিবাদী সরকার আর কখনো না আসুক।’
তিনি আরও বলেন, আসিফের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রতিদিন আসিফের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু ১৯ জুলাই তার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর বিভিন্ন জায়গায় তাকে খোঁজ করেও পাইনি। ২৩ জুলাই জাতীয় একটি পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়, আসিফ মাহমুদকে গুম করা হয়েছে। তারপর আমরা শাহবাগ থানায় নিখোঁজের ডায়েরি করতে গেলে ওসি আমাদের জিডি নেননি। সেখান থেকে যাত্রাবাড়ী থানায় যাই, সেখানেও একইভাবে আমাদের ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। তারপর ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে খোঁজ করি, কিন্তু আসিফের কোনো সন্ধান না পেয়ে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করেও পাইনি। তারপর প্রেসক্লাবে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আসিফের গুমের বিষয়টি দেশবাসীকে জানাই।
বিল্লাল হোসেন বলেন, ২৪ জুলাই হাতিরঝিল এলাকায় আসিফ মাহমুদকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। এসময় তাকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য নিলে সেখান থেকে ২৬ জুলাই পুলিশ পরিচয়ে আবারও তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৭ জুলাই ডিবি কার্যালয় থেকে ফোন করে জানায়, আপনার ছেলে ডিবি কার্যালয়ে আছে, দেখে যান। আমি আর আসিফের মা সেখানে গিয়ে দেখা করলে তাদের ছেড়ে দেবে বললেও পরে ছাড়েনি।
তিনি আরও বলেন, আসিফ ছোটবেলা থেকেই একরোখা ছিল। যেখানে অন্যায় দেখত, সেখানেই প্রতিবাদ করত। ছেলেটার একরোখা স্বভাব তাকে আজ সরকারের উপদেষ্টা বানিয়েছে। একজন বাবা হিসেবে আমি অনেক গর্বিত। আমি আমার শিক্ষকতা জীবনকে সার্থক মনে করছি ছেলের এমন সাফল্য।