নেত্রকোনায় শালুক বিক্রি করেই সংসার চলে অসংখ্য পরিবারের
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : হাট-বাজারে সিদ্ধ শালুক বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন নেত্রকোনার অসংখ্য কৃষক ও দিনমজুর। যে কারণে শ্রাবণ-ভাদ্র ও আশ্বিন মাসজুড়ে তারা ব্যস্ত সময় পার করেন শালুক তোলার কাজে। এই সময় প্রতিদিন সকালে খাল, বিল ও জলাশয় থেকে বিপুল পরিমাণে শালুক তোলেন। পরে সেগুলো সিদ্ধ করে চড়া দামে বিক্রি করছেন নেত্রকোনা শহরে। বর্তমানে এক কেজি শালুক বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা থেকে ২০০ টাকা। শুধু শালুক বিক্রি করেই চলে শতশত কৃষক ও দিনমজুর পরিবারের জীবন-জীবিকা চলে।একাধিক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, শালুক দেখলেই নাকি তাদের অভাবের সেই দিনগুলোর স্মৃতি চোখে ভেসে ওঠে। কারণ মাত্র একযুগ আগেও নেত্রকোনার গ্রামগঞ্জের অভাব-অনটনে থাকা মানুষের পেটের ক্ষুধা মেটানোর প্রধান খাবার ছিল এই শালুক। তখন বর্ষাকাল এলেই একরকম শালুক সিদ্ধ খেয়েই জীবন বাঁচাতেন তারা। তবে বড়লোকেরা সেসময় শালুক সিদ্ধ খেতেন শখ করে। কিন্তু গরিবের ক্ষুধা নিবারণের সেই খাবার শালুক এখন গবির-বড়লোক দুই শ্রেণির মানুষের কাছেই জনপ্রিয়। যে কারণে হাট-বাজারে শালুকের দাম এমন বেপরোয়া।
নেত্রকোনা শহীদ মিনারের সামনে শালুক বিক্রেতা আমজাদ শেখ বলেন, শালুক উৎপাদন করতে খরচ নেই। বর্ষাকালে এমনিতেই (প্রাকৃতিকভাবে) বিল ও জলাশয়গুলোয় অবহেলা-অযত্নে শাপলার সঙ্গেই বেড়ে ওঠে শালুকের গাছ। একসময় সেসব গাছের গোড়ায় কালো রঙের একাধিক গুটি জন্মায়। পরে ওই গুটি বড় হয়ে শালুক উৎপাদন হয়। শুধু কষ্ট করে পানির নিচ থেকে ওই শালুকগুলো তুলে বাড়িতে নিয়ে পরিষ্কার করি। পরে সেগুলো গরম পানিতে সিদ্ধ করে হাট-বাজার ও শহরে নিয়ে আসলেই ভালো দাম পাওয়া যায়। তাই এই সময় অন্য কারো কাজ করি না। শালুক বিক্রি করেই অনেক টাকা আয় করছি। বারহাট্টা বাজারের শালুক বিক্রেতা রফিকুল মোল্যা বলেন, প্রতিদিন সকালে জলাশয় থেকে অন্তত ১৫ থেকে ২০ কেজি শালুক সংগ্রহ করি। পরে সেগুলো সিদ্ধ করে বিকালে হাট-বাজার ও শহরে নিয়ে বিক্রি করছি। বর্তমানে গ্রামের হাট-বাজারে প্রতি কেজি শালুক বিক্রি করছি ১৬০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা করে। আর শহরে নিয়ে প্রতি কেজি ২০০ টাকা করে বিক্রি করছি। এতে প্রতিদিন আমার আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা আয় হচ্ছে। এখন যদি অন্যের জমিতে সারাদিন কাজ করতাম, তাহলে সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পেতাম। তা দিয়ে আমার সংসার চালাতে কষ্ট হইতো। তবে বর্তমানে শালুক বিক্রি করে ভালোভাবে সংসার চালাচ্ছি। পাশাপশি উপার্জনের কিছু টাকা সঞ্চয় করেও রাখতে পারছি।
মোহনগঞ্জ বাজারে শালুক কিনতে আসা নুরুল ইসলাম বলেন, ক্ষুধা মেটানোর জন্য নয়, বর্তমানে শখ করে শালুক খাচ্ছে সবাই। প্রায় দিনই বাজারে আসার সময় পরিবারের সদস্যরা শালুক কিনে আনার বায়না ধরে। তাই দাম যতই হোক, শালুক কিনে নিয়ে যাচ্ছি। বিধান মণ্ডল নামে এক চিকিৎসক বলেন, সবজি জাতীয় খাদ্য শালুক হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। দ্রুত ক্ষুধা নিবারণ করে এবং শরীরে পর্যাপ্ত শক্তি জোগায়। এটি একটি ভালো সবজি হিসেবে সমাদৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চুলকানি ও রক্ত আমাশয় নিরাময়ের জন্য ঔষধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। যে কারণে শালুকের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নেত্রকোনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, বাণিজ্যিকভাবে শালুক আবাদের প্রয়োজন হয় না। বর্ষাকালে প্রাকৃতিকভাবেই নেত্রকোনার বিভিন্ন জলাশয়ে শালুক উৎপাদন হয়। এতে অল্প সময়ের জন্য হলেও গরিব মানুষের একটা কর্মসংস্থান তৈরি হয়। শালুক হলো আলু জাতীয় খাদ্য, এক ধরণের রাইজোম বা কন্দ। ফলটি পুষ্টিগুণে ভরা থাকে। শালুক পুড়িয়ে বা গরম পানিতে সিদ্ধ করে খাওয়া যায়। শালুক কোনো ক্ষতিকর উপাদান নয়।