নেত্রকোনায় বিলুপ্তির পথে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য হুক্কা

Share the post
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : নেত্রকোনা জেলার সকল প্রত্যন্ত অঞ্চলে একসময় হুক্কার ব্যাপক প্রচলন ও কদরছিল। এমনকি হুক্কার পানিও মহাষৌধী হিসেবে অনেক কাজ করতো। আজ গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য হুক্কার প্রচলন কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাবার পথে। আর এ ঐতিহ্য হারিয়ে যাবার অন্তরলে রয়েছে মানুষের শরীরের ক্ষতিকর নিকোটিন সমৃদ্ধ বিড়ি ও সিগারেটসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য। জানা যায়, এখন থেকে তিন অথবা চার দশক আগেও নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে ধুমপায়ীরা হুক্কার নেশায় অভ্যস্থ ছিল। উঠতি বয়সের তরুণ থেকে শুরু করে বয়স্ক, বিত্তবান, ধনী ও দরিদ্র শ্রেণির অনেকের বাড়িতে এ হুক্কার ব্যাপক প্রচলন ছিল। গ্রামগঞ্জের বৈঠকখানাগুলোতে পালাক্রমে হুক্কা টানতো বিভিন্ন বয়সের পুরুষরা। আর বৃত্তবানদের বাড়িতে ছিল নলের হুক্কা। অধিকাংশ বৃত্তবানরা চেয়ারে গা এলিয়ে আয়েশি ভঙ্গিমাতে গৃহকর্তা নলের পাইপ মুখে দিয়ে যখন জমিদারী ভঙ্গিমায় হুক্কা টানতো। তখন এ দৃশ্যপানে অপলক নেত্রে চেয়ে থাকতো বৈঠকখানায় অগতরা। তামাক পাতা টুকরো টুকরো করে কেটে রোদে শুকিয়ে তাতে খেজুর গাছের চিটাগুড় মিশ্রিত করে তৈরি করা হতো হুক্কার প্রধান উপাদান। নারকেলের ছিদ্র করা মালার উপর কাঠের ডান্টা লাগানো আর তার উপরে অংশে মাটির কলকের ভিতরে মিশ্রিত প্রধান উপাদানের উপরি ভাগে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মালার ছিদ্র মুখে লাগিয়ে উপরের দিকে নিশ্বাস নিলে নিঃসৃত ধোঁয়া হুক্কার তলানির পানিতে কুড়-ত কুড়-ত শব্দ করলে একপ্রকার সুমিষ্ট ঘ্রাণ বের হয়ে আসতো তা থেকে।বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে এ দৃশ্য দেখা সম্ভব না হলেও হুক্কার কুড়ুত কুড়ুত শব্দেই দূর থেকেও বোঝা যেত আশপাশে কেউ হুক্কা টানছে। এখন আর সেই পরিচিত শব্দটি নেই। কালের অবর্তনে হারিয়ে গেছে এ হুক্কার প্রচালন। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এখনো হুক্কা দেখেনি।
আবহমান বাংলার জনপ্রিয় গান ‘আমার মান কুল মান সব হারাইলাম, এই হুক্কার সঙ্গ ধরে রে, ও সাধের হুক্কারে, তোরে ছাড়া প্রাণ বাঁচে না, রই কেমনে ঘরে…; পরানের হুক্কারে তোর নাম কে রাখিল ডাব্বা?’ অথবা রম্য ছড়া ‘হায়রে সে-ই হুক্কা, উপরে তার তামাক-কলকি, নিচের দিকে চুক্কা, হায়রে সে-ই হুক্কা/নানা বলে নানি বলে, হুক্কা ছাড়া জীবন চলে? হুক্কার পেট ভরা জলে, টানছে দেখ দুজন মিলে, হায়রে সে-ই হুক্কা।’নেত্রকোনা থেকে বিলুপ্তির পথে আবহমান বাংলার হুক্কা। এক সময়ের ধূমপানের অন্যতম অনুষঙ্গ ‘হুঁকা’ বা হুক্কা নিয়ে রচিত এসব গান, ছড়া এখনও দেশের সংস্কৃতিতে পরিচিত হলেও হারিয়ে গেছে বস্তুটি। এখন শহর দূরের কথা, গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেও পাওয়া যায় না হুঁকার দেখা। কালের বিবর্তনে অনেকটা হারিয়ে গেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হুঁকা। তিন-চার দশক আগেও বাংলার গ্রামগঞ্জে ধূমপায়ীরা হুঁকার মাধ্যমে তামাকপানের নেশায় ছিল অভ্যস্ত। সে সময় দেশের প্রায় সব বাড়িতেই ছিল এর প্রচলন। তখনকার দিনে গ্রাম্য সালিশ, সামাজিক অনুষ্ঠান বা জমায়েতে ছোটবড় সবাইকে হুঁকায় আপ্যায়নের রীতি ছিল। প্রতিটি গ্রামের প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী বাড়িতে লম্বা পাইপযুক্ত স্ট্যান্ড হুঁকা ওই বাড়ির শোভাবর্ধন ও প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করত। বর্তমান প্রজন্মের কাছে হুঁকা একটি অপরিচিত বস্তু। এটি খাওয়া দূরের কথা, চোখেই দেখেনি তারা। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী এ হুঁকার জায়গায় বাজার দখল করেছে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নিকোটিনযুক্ত সিগারেট-বিড়ি। প্রজন্মের একটা বড় অংশ নিষিদ্ধ মাদকের নেশায় মাতোয়ারা। অথচ কম নিকোটিনযুক্ত হুঁকার প্রচলন থাকলে যুবসমাজকে মাদক গ্রহণের অধঃপতন থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করা যেত।
দূর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর গ্রামের হুক্কা ব্যবহারকারী ষাটোর্ধ বয়সি হরে কৃষ্ণ বলেন, একসময় আমাদের এলাকায় প্রায় সবার বাড়িতে ধুমপায়ু হুক্কা ব্যবহার করা হতো। এখন অত্র এলাকার মধ্যে আমার বাড়ি ছাড়া আর কোথায় এর ব্যবহার চোখে পড়েনা। মাঝে মধ্যে অনেক দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসে আমার বাড়িতে হুক্কার পানি নিতে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হুক্কার পানি বসফোড়া,গলাফোলা নিরাময় এবং ক্ষতস্থান পরিস্কার করাসহ বিভিন্ন ধরনের মহাষৌধী হিসেবে কাজ করে। তবে, হুক্কার সেই স্থান বর্তমানে দখল করে নিয়েছে বিড়ি, সিগারেটসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য। যাতে রয়েছে মানব দেহের বসচেয়ে বেশি ক্ষতিকর নিকোটিন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

নেত্রকোনায় গুলিতে একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান হারিয়ে অকুল পাথারে রাসেলের পরিবার

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : গুলিতে নিহত রাসেল মিয়া। গাজীপুরের মাওনায় মোরগের গাড়িতে হেলপারের কাজ করতেন রাসেল মিয়া (১৯)। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণের জন্য কিশোর বয়স থেকেই এ কাজে যোগ দিয়েছিলেন। গত ৫ আগস্ট বিকেলে মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের পোশাক পরা ভারতীয়দের আটক করে জনতা। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ভগ্নীপতির […]

নেত্রকোনায় বিদ্যালয়ের কাজ না করেই বরাদ্দের টাকা ৫০ লাখ টাকা উত্তোলনের অভিযোগ

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোণা : নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার বরইতলা এন আই খান উচ্চ বিদ্যালয়ের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হলেও প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু হয়নি।২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে উন্নয়ন সংশোধিত বাজেটে ‘ইউনিয়ন পরিষদ উন্নয়ন সহায়তা’ খাতের আওতায় ইউনিয়নের অনগ্রসরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং […]