সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা: নেত্রকোনার মদন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীরা পাচ্ছে না কাংখিত চিকিৎসা ও সরকারি ওষুধ। মদন উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ কৃষক আর দিনমুজুর। এসব গরিব মানুষেরা রোগে আক্রান্ত হলে তাদের একমাত্র ভরসা সরকারি হাসপাতাল। তবে ভরসার সেই হাসপাতালে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না তেমন কোনো সরকারি ওষুধ,আর স্বাস্হ্য কমপ্লেক্সের চারপাশে ময়লা আবর্জনার দূর্গন্ধ। চিকিৎসকরা রোগ নির্ণয় করে অসহায় রোগীদের হাতে লিখে দিচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানির দামি ওষুধের কাগজ। যা কিনে খাওয়ার সক্ষমতা অনেকের নেই। ফলে সরকারি ওষুধ তেমন না পেয়ে খালি হাতেই ফিরে যেতে হচ্ছে। এমনই অবস্থা চলছে মদন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। আরও অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন ডাঃ মোঃ আলী সাইফুল্লাহ সজীব। তাই সরকারি ওষুধ উধাও করে দিয়ে রোগীদের বড় কোম্পানির ওষুধ লিখে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে চুক্তি অনুযায়ী ওষুধ লিখে দিচ্ছে কি না তা পরীক্ষা করতে হাসপাতালে আসা ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিদের টানাহেঁচড়ায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন রোগীরা।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের করুণ দৃশ্য, রোগীদের আর্তনাদ ও নোংরা পরিবেশ। চিকিৎসকের রুম থেকে রোগীরা বের হলেই বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাদের হাতে থাকা ব্যবস্থাপত্র নিয়ে টানাটানি করছে ও ছবি তুলছে। যদিও সকাল ৯টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত হাসপাতালে ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিদের প্রবেশ নিষেধ। তারপরেও বেলা ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত হাসপাতালের গেটে রোগীদের নিয়ে টানাহেঁচড়া করতে দেখা গেছে। অন্যদিকে দেখা যায়, যেখানে-সেখানে পড়ে রয়েছে হাসপাতাল ভবনের দেয়ালের টাইলস। নতুন বেডগুলো (যা এখনো ব্যবহার করা হয়নি) ধুলা-ময়লায় ডেকে গেছে। টয়লেটগুলো ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে আছে। অনেক জায়গায় ময়লা-আবর্জনা জমে বের হচ্ছে দুর্গন্ধ। ওয়াশরুমের বেসিনগুলো ভাঙ্গাচুরা। সব মিলিয়ে যেন ভূতরে পরিবেশ চলছে চিকিৎসাসেবা। দেখে বোঝার উপায় নেই হাসপাতালটি চিকিৎসা সেবার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। এদিকে মদন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এই বেহাল অবস্থা নিয়ে সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি তার ফেইসবুকে লিখেছেন,কৃর্তপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি,মদন উপজেলা হাসপাতালে চারদিকে নোংরা পরিবেশ, এখানে রোগী সুস্থ হতে আসে,এই পরিবেশ দেখে,উল্টো আরো অসুস্থ হয়ে যাবে,,নার্স কে জিজ্ঞেস করলাম চারদিকে এতো নোংরা কেন? বলে আমাদের এখানে কোনো আয়া নেই। জিজ্ঞেস করলাম পরিস্কার করে কে? বলে আমরাই,এখন এগুলো দেখার কি কেউ নেই? স্বাস্হ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার এ কে এম রিফাত সাইয়িদ বলেন, জনবল সঙ্কটের কারণে হাসপাতালের পরিবেশ এমন হয়েছে। সুইপার,আয়া না থাকায় টয়লেট নোংরা। আর টাইলসগুলো খুলে পড়ছে অনেক আগে থেকেই।স্বাস্হ্য কমপ্লেক্সের ভবনের কাজ মানসম্পন্ন না হওয়ায় টাইলস খুলে পড়ছে বলে মনে করি। নাসিমা আক্তার নামে এক ভ্যানচালকের স্ত্রী বলেন, টাকার অভাবে শিশু বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূর থেকে হাসপাতালে এসেছি সরকারি চিকিৎসা ও ওষুধ নিতে। কিন্তু চিকিৎসক ওষুধ লিখে দিয়েছে, সরকারি কোনো ওষুধ দেয়নি। সরকারি ফ্রি ওষুধ নেই বলে জানিয়েছে। কিন্তু যে ওষুধ লিখে দিয়েছে তা কেনার মতো টাকা আমার কাছে নেই। চান মিয়া নামে এক কৃষক বলেন, চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে ওষুধ লিখে দিয়েছে। একটা সরকারি ওষুধও দেয়নি। আমি এসেছিলাম, ডা. দেখিয়ে ফ্রি ওষুধ নিতে। কিন্তু পেলাম না, তাই খালি হাতে ফিরে যাচ্ছি। সূত্র সেন নামে আরেক রোগী বলেন, আমার শ্বাস কষ্টে সমস্যা। অথচ চিকিৎসক একপাতা প্যারাছিটামল দিয়েছে আর কোনো ওষুধ দেয়নি। সব ওষুধ লিখে দিয়েছে। বাইরে দোকান থেকে কিনে খেতে বলেছে। বাইরে বের হওয়ার সময় একদল লোক আমার ওষুধের কাগজ হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছবি তোলে রেখেছে। হাসপাতালের সামনে অবস্থানরত রাজু নামে একটি ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধি বলেন, আমরা কারো কাছ থেকে জোর করে ছবি তোলা হয় না। হাসপাতাল থেকে বের হলে রোগীদের অনুরোধ করে ছবি তুলি। এটা আমাদের কোম্পানি দায়িত্ব দিয়েছে, কি করবো বলেন।
হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধর বিষয়টি জানতে চাইলে ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিরা বলেন, কোম্পানির সঙ্গে হাসপাতালের কারো চুক্তি হয়েছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু আমাদের দায়িত্ব পালন করছি। এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্হ্য কমপ্লেক্সের ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. নয়ন চন্দ্র ঘোষ বলেন, কোনো ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। কিছু ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিরা বাইরে এসে রোগীর ব্যবস্থাপত্রের ছবি তোলে। আজকেও আমি কয়েকজন ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিকে বের করে দিয়েছি। এরপরেও ওরা আসে, যা আমি অনেক সময় জানিও না। নোংরা পরিবেশ সম্পর্কে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, সুইপার ও পরিছন্নতাকর্মীর পদে কোনো লোক নেই। যে কারণে পরিবেশ একটু নোংরা। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। নেত্রকোনা সিভিল সার্জন ডাঃ অনুপম ভট্টাচার্য্য বলেন, সরকারি ওষুধ থাকা সত্ত্বেও রোগীদের কোম্পানির ওষুধ লিখে দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে সব সময় সব ওষুধ দেওয়া সম্ভব হয় না। তারপরও অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর কোম্পানি প্রতিনিধিরা যাতে হাসপাতালে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জনবল সঙ্কটের কারণে হাসপাতালে যে নোংরা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সে বিষয় আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি।