সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : নেত্রকোণার মাঠে পুরোদমে চলছে আমন চাষের ব্যস্ততা। জেলার উঁচু ও পাহাড়ি সীমান্তবর্তী এলাকায় এই ফসলের চাষ সবচেয়ে বেশি। তবে সার ও বীজের দাম বাড়ায় চাষের খরচ বেড়েছে। চলতি মৌসুমে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক হয়েছে ১৮শ’ কোটি টাকা। কৃষি বিভাগ বলছে, এই ফসল উৎপাদন ও চাষে কৃষকদের দেয়া হচ্ছে নানা পরামর্শ। প্রায় ৪০ কাঠা জমিতে আমনের চাষ করেছেন রতন মিয়া। ধানের চারা রোপণের পর পরিচর্যায় মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে চলতি মৌসুমে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় খরচ বেড়েছে। সম্পূর্ণ জমি চাষাবাদে তার খরচ হবে প্রায় ৭০ হাজার টাকা। ফলন ভালো হলে চাষাবাদের খরচ মিটিয়ে ২০ হাজার টাকা আয়ের আশা তার। জমিতে সেচ খরচ কম হওয়ায় আমন চাষে কৃষকের আগ্রহ বেশি। জেলার হাওর বিস্তৃত চার উপজেলা বর্ষার পানিতে ডুবে থাকায় সীমান্তবর্তী দুর্গাপুর,কলমাকান্দা বারহাট্টা,নেত্রকোনা সদর, পূর্বধলাসহ ছয়টি উপজেলায় আমনের চাষ হয় সবচেয়ে বেশি। পাহাড়ি ও উঁচু জমিগুলোতে আমন চাষ করেই সারা বছরের খরচ মেটায় কৃষকরা।
এদিকে জেলার কেন্দুয়ায় আমন ধানের চারা রোপণ করছেন কৃষকরা। চলতি মৌসুমে বৃষ্টি কম হলেও এখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় তড়িঘড়ি করেই মাঠে নেমেছেন কৃষকরা। কৃষকরা বলছেন, আমন ধান কেটে ঘরে তুলেই আলু ও সরিষা আবাদ করবেন। সে লক্ষ্যেই আমন ধান রোপণ শুরু করেছেন কৃষকরা। কেন্দুয়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে উপজেলা ১৩ ইউনিয়ন ও ১ পৌরসভাজুড়ে ২০ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে আমন ধান রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রায় দুই হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে ধান রোপণ শেষ হয়েছে। আমন ধান কেটে ঘরে তোলার পর কৃষকরা মাঠে আলু ও সরিষাসহ বিভিন্ন প্রকার রবিশস্য আবাদের লক্ষ্য নিয়ে আগাম জাতের আমন ধান রোপণ করছেন। আমন ধানের বেশকিছু হাইব্রিড ও উফশী জাত আগাম ধানের জাত হিসেবে কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে ব্রি ৩৩, ৩৯, ৫৬ , ৭২, ৭৫, বিনা ১৭, স্বর্ণা-৫ সহ বিভিন্ন জাতের ধান রয়েছে। উপজেলার পাইকুড়া ইউনিয়নের কৃষক শহিদ মিয়া জানান, চলতি মৌসুমে তিনি প্রায় ১০ বিঘা জমিতে ধান রোপণ করছেন। ধান কেটে জমিতে সরিষা আবাদ করবেন। গত বছর আমন মৌসুমে ধান কেটে প্রায় ৫ বিঘা জমিতে আলু সরিষার আবাদ করেছিলেন। এতে বেশ লাভবান হয়েছেন বলে জানান তিনি।
চিরাং ইউনিয়নের কৃষক সাইদুল মিয়া জানান, এবার তিনি ৩ বিঘা জমিতে বিনা ১৭ ও জিরাশাইল জাতের ধান রোপণ করছেন। ধান কেটে সব জমিতেই আলু ও সরিষা আবাদ করবেন। এদিকে রোয়াইলবাড়ি আমতলা ইউনিয়নের কৃষক আনোয়ারুল হক জানান, এবার বৃষ্টিপাতের প্রকোপ অনেকটায় কম। তবে এখন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে তড়িঘড়ি করেই জমিতে আমন ধান রোপণ করতে হচ্ছে। কৃষকদের মতে, গত বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ ভালো হওয়ায় ফলনও ভালো হয়েছে। সেইসঙ্গে বাজারে বিক্রিতে দাম ভালো পাওয়ায় বেশ লাভবান হয়েছেন। কেন্দুয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা জানান, চলতি মৌসুমে ২০ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেড় হাজার কৃষকের মাঝে বীজ ও সার প্রণোদনা হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় দুই হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে ধান রোপণ শেষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি। স্বল্প খরচের আশায় আমন চাষ করলেও এবার বীজ, সার ও কীটনাশকের দাম বাড়ায় প্রভাব পড়েছে চাষাবাদে কৃষকরা বলছেন, চলতি বছর কাঠা প্রতি প্রায় খরচ বেড়েছে ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। শ্রমিকের মজুরি আর ফসল ঘরে তুলতে গুনতে হবে আরো বাড়তি অর্থ। তবে এখন পর্যন্ত পাহাড়ি ঢল কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় কিছুটা স্বস্তি রয়েছে কৃষকের মাঝে। মাঠ গুলোতে ব্রি-৭৫, ব্রি-৮৭, বিনাধান ১৭, স্বর্ণা, রঞ্জিতসহ উচ্চ ফলনশীল ধান আবাদ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। প্রায় শেষ চারা রোপণ। চলতি মৌসুমে জেলায় প্রায় এক লাখ ৩৫ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই থেকে চাল উৎপাদন হবে প্রায় ৪ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৭ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য ১৮শ কোটি টাকা। কৃষি বিভাগ বলছে, স্বল্প সময়ের এই ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে যেন এ ফসল ঘরে তোলার পর জমিগুলোতে সরিষাসহ অন্যান্য ফসল চাষাবাদ করতে পারে।
আগস্ট মাসের মধ্যে বেশিরভাগ জায়গায় ধান রোপন করা শেষ হয়েছে। নতুন আমনের জাত ব্রি ধান- ৭১, ব্রি ধান- ৭৫, ব্রি ধান- ৮৭ এবং বিনাধান ১৭ এই উচ্চফলনশীল জাতগুলো চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বলে জানালেন নেত্রকোণা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান। নেত্রকোণায় সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় আমনের। গত বছর জেলায় ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯০ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের আবাদ হয়। যা থেকে উৎপাদিত ৩ লাখ ৯০ হাজার ৫২২ মেট্রিক টন চাল বাজারে বিক্রি হয় ১ হাজার ৭২০ কোটি টাকায়।