সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : নেত্রকোনার খালবিলে নদী-নালায় ঢুকেছে নতুন পানি। বেড়েছে দেশী মাছের আনাগোনা। আর এই সুযোগে অসাধু মৎস্য শিকারিরা নেমেছে এসব মাছ নিধনে। প্রতিদিন স্থানীয় হাট-বাজারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে মাছ। বিশেষ করে ছোট মাছ ও পোনা মাছ বিক্রি হচ্ছে বেশি। এর মধ্যে চাহিদা বেড়েছে মাছ শিকারের বিভিন্ন উপকরণের। বেশি চাহিদা নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী জাল। তাই চলনবিলের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট কারখানায় অবাধে এসব চায়না দুয়ারী জাল তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এমনই এক চায়না জালের সন্ধান মিলেছে জেলার প্রতিটি বিলে বিলে। জেলার প্রতিটি ইউনিয়নের গ্রামে রয়েছে এই চায়না জাল। যেখানে দিনে দুপুরে প্রশাসনের নাকের ডগায় অবাধে এসব জাল দিয়ে মাছ ধরে ও বিক্রি হচ্ছে চায়না দুয়ারী জাল। প্রতিটি ইউনিয়নে নির্বিঘ্নে নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের চেয়েও ক্ষতিকর চায়না দুয়ারী জাল দিয়ে অবাধে মাছ নিধন করছেন এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও মাছ শিকারী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জলজ জীববৈচিত্রের জন্য চায়না দুয়ারী জাল বা মাছ ধরার এ ফাঁদ কারেন্ট জালের চেয়েও ক্ষতিকর। এ জাল সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে মাছ আটকে রাখতে সক্ষম। জালের বুননে এক গিঁঠ থেকে আরেক গিঁঠের দূরত্ব খুব কম হওয়ায় মাছ বা অন্য কোন ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী একবার এ জালের মধ্যে প্রবেশ করলে আর বের হতে পারে না। অন্য জালের চেয়ে কম পরিশ্রমে চায়না দুয়ারী জালে অধিক পরিমাণ মাছ পাওয়া যায়। ফলে এ এলাকার জেলেদের কাছে কদর বেড়েছে চায়না দুয়ারী জালের।
জেলেরা এখন মাছ ধরতে কারেন্ট জালের পরিবর্তে ঝুঁকছেন চায়না দুয়ারী জালের দিকে। উৎপাদন, বিক্রয়, বিপণন, ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও নেত্রকোনার প্রতিটি বিল, নদীগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার জাল পেতে মা ও পোনা মাছ নিধন করছেন অসাধু মৎস্যজীবীরা। ফলে ক্রমশই বিলুপ্ত হচ্ছে দেশী প্রজাতির মাছ। এ জালের ব্যবহার অব্যাহত থাকলে মাছের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। জলজ জীব বৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে। বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন নদীনালা,খালবিলে মা মাছ, পোনা মাছ সহ ছোট বড় নানা রকম দেশী মাছের অবাধ বিচরণ দেখা দেয়। কিন্তু এই সময়েই এসব মাছ নিধন শুরু হয়ে যায়। আর দেশী মাছ নিধনের প্রধান ফাঁদ হয়ে দেখা দিয়েছে চায়না দুয়ারী জাল। বর্তমানে জেলার নদ নদী, খাল, বিলে চায়না দুয়ারি জালে পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধনের মহোৎসব চলছে। প্রতিটি বিলে পুটি, রিঠা, শোল, বোয়াল, টাকি, টেংড়া, শিং, কই, রুই, কাতলা সহ বিভিন্ন দেশি মাছের পোনা শিকার করে বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি চলছে। এতে মৎস্য ও জলজপ্রাণী যথেচ্ছভাবে নিধন হওয়ায় প্রাকৃতিক মাছ উৎপাদনে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। জেলার মৎস্যজীবী ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সারা দেশে চায়না দুয়ারির ব্যবহার শুরু হয় বছর পাঁচেক আগে। শুরুতে এই জাল চীন থেকে আমদানি করার কারণে এর নাম দেওয়া হয় চায়না দুয়ারি। তবে এখন এ ধরনের জাল দেশেই তৈরি হচ্ছে। সূক্ষ্ম জালে গোলাকৃতি বা চারকোনার রড পরিয়ে খোপ খোপ করে বিশেষ ধরনের ফাঁদ তৈরির মাধ্যমে এটি তৈরি করা হয়। এই ফাঁদ উচ্চতায় দেড় থেকে ২ ফুট এবং লম্বায় ৬০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে।অল্প বা গভীর, যেকোনো পানিতে এই ফাঁদ পেতে রাখলে তাতে বড় মাছ, মাছের পোনা, এমনকি ডিম পর্যন্ত ধরা পড়ে। দ্রুত এই জাল মাছ শিকারিদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়। তবে মাছের জন্য মারাত্মক হুমকি হওয়ায় মৎস্য অধিদপ্তর এই জাল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই জাল দিয়ে পোনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন আকারের মাছ ধরায় জেলার নদী ও অন্য প্রাকৃতিক জলাশয় মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। বাজারে পোনা বা ছোট আকারের দেশি মাছ মিললেও স্বাভাবিক আকারের দেশি মাছ মিলছে না বললেই চলে।
জেলার বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ বিক্রি হচ্ছে। বিলে বর্ষার নতুন পানি প্রবেশের সাথে সাথে প্রতিটি অঞ্চলে এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ ও জেলে কারেন্ট জাল, সোতি জাল, বাদাই জাল, ধর্মখরা, খেয়া জালের মত অতি সুক্ষ নিষিদ্ধ জাল দিয়ে পোনা ও ডিমওলা মা মাছ ছেঁকে তুলছে। এতে এ অঞ্চলের হারিয়ে যেতে বসেছে ৫০ প্রজাতির মিঠা পানির সুস্বাদু মাছ। এর মধ্যে বিভিন্ন নদী-নালা, খাল-বিল প্রবাহিত হয়ে বিল অঞ্চলের ও এর শাখা নদীর পাড়ে পোনা বিক্রয়ের জন্য ছোট বড় প্রায় ২০০ আড়ত গড়ে উঠেছে। এসব আড়তে পোনা সংগ্রহের কাজ চলে বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত। স্থানীয়রা জানান, সারা রাত ধরে পোনা ও মা মাছ শিকার করা হয় এবং রাত পোহানোর আগেই বিলপাড়ে আগে থেকে প্রস্তুত থাকা যানবাহনে ওই মাছ চলে যায় বিভিন্ন আড়তে। প্রশাসন এসব দেখেও না দেখার ভান করছেন। দেড় দশক আগেও এ অঞ্চলের নদী-বিল ও জলাশয়ে প্রায় আড়াইশ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের দেখা যেত। কিন্তু এখন এ অঞ্চলে দেশি প্রজাতির মিঠাপানির মাছের সেই জায়গা দখল করেছে চাষের মাছ। বর্ষার পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে বিলে প্রচুর পরিমাণ মা মাছ ডিম ছাড়ার জন্য আসছে। এ সুযোগে এক শ্রেনীর অসাধু জেলে বিলের বিভিন্ন পয়েন্টে মাছ ধরার কারেন্ট জাল, বাদাই জালসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে নির্বিচারে মা মাছ নিধন করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন মৎস্যজীবী বলেন, বর্তমানে মা মাছের ডিম পাড়ার সময়। এ সময় রেণু ও পোনায় এলাকা ছেয়ে যায়। তাছাড়া মাছগুলো নীরব থাকায় শিকারেও সুবিধা হয়। এতে কেউ তো বাধাও দিচ্ছে না।