কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিতে আহত নবী হোসেনকে মৃত ভেবে ফেলে যায় পুলিশ

Share the post
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : গাজীপুরে একটি সোয়েটার কারখানায় কাজ করতেন নবী হোসেন (২৩)। গত ৪ আগস্ট শহরের বাইপাস এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বড় ভাইয়ের সঙ্গে তিনি যোগ দেন। এদিন বিকেল ৪টার দিকে আন্দোলনে বেপরোয়াভাবে গুলি ছুড়ে পুলিশ। পাশাপাশি ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা–কর্মীরা বেধড়ক পেটাতে থাকে আন্দোলনকারীদের। ছররা গুলি লেগে মুহূর্তেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন নবী হোসেন। এদিকে রাস্তায় পড়ে থাকা নবী হোসেনকে পুলিশ বুট জুতা দিয়ে আঘাত করতে থাকে। আর ছাত্রলীগ-যুবলীগের ৮-৯ জন মিলে লোহার রড দিয়ে পেটাতে থাকে। একপর্যায়ে জ্ঞান হারালে মৃত ভেবে নবী হোসেনকে রাস্তার পাশে একটি বাড়ির প্রধান ফটকের ভেতর নিয়ে কম্বল দিয়ে ঢেকে ফেলে যায় পুলিশ। ঘণ্টা দুয়েক পর জ্ঞান ফেরে নিজেকে কম্বলে ঢাকা অবস্থায় দেখতে পান নবী হোসেন। কোনো রকম মুখ বের করে সেই ভবনের লোকজনের কাছে সহায়তা চেয়ে বলেন, ‘আমি জীবিত আছি, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।’সেদিনের ঘটনার বর্ণনাগুলো দিয়েছেন নবী হোসেনের বড় ভাই জামাল মিয়া (২৬)। বর্তমানে নবী হোসেনের শরীরে অসংখ্য ছোররা গুলি এবং ক্ষত নিয়ে ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। শরীরে তীব্র ব্যথা থাকায় এখন ঠিকভাবে কথা বলতে পারছেন না তিনি।
জানা গেছে, নবী হোসেন নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার বাউসী ইউনিয়নের দেওপুর গ্রামের নসর জমার ছেলে। তাঁরা সাত ভাই ও এক বোন। সবার মধ্যে পঞ্চম তিনি। গ্রামের স্কুলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। অভাবের কারণে আর এগোয়নি পড়াশোনা। তিন-চার বছর আগে গাজীপুরে গিয়ে একটি সোয়েটার কারখানায় কাজ শুরু করেন। বাবা নসর জমা পেশায় কৃষক। বাড়ির জায়গাটুকু ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই। নবী হেসেনের বড় ভাই জামাল মিয়া নেত্রকোনা এন আকন্দ মাদ্রাসায় ফাজিল অধ্যয়নরত। অন্য ভাইয়েরা কৃষিকাজ করেন। জুলাই মাসের শেষের দিকে ছোট ভাইকে দেখতে গাজীপুরে গিয়েছিলেন জামাল মিয়া। সেখানে যাওয়ার পর দুই ভাই মিলে যোগ দেন আন্দোলনে। সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) মো. জামাল মিয়া এই প্রতিনিধিকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ দেখে আর থাকতে পারিনি। দুই ভাই মিলে যোগ দিই আন্দোলনে। ৪ আগস্ট সকাল থেকে দুজন এক সঙ্গেই ছিলাম। বিকেল ৪টার দিকে পরিস্থিতি বেগতিক হয়ে যায়। পুলিশ ব্যাপকভাবে গুলি, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। চলতে থাকে ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়া। একপর্যায়ে অগণিত ছররা গুলি নবী হোসেনের শরীরে বিদ্ধ হলে সে রাস্তায় পড়ে যায়। ধাওয়া খেয়ে আমরা তখন অন্য গলিতে গিয়ে আশ্রয় নেই। তার পর থেকে তাকে আর পাইনি।’নবী হোসেন মমেকে ভর্তি থাকা অবস্থায় মো. জামাল মিয়া বলেন, ‘পুলিশ রাস্তায় ফেলে নবী হোসেনকে বুট জুতা দিয়ে আঘাত করেছে। আর ছাত্রলীগ-যুবলীগের লোকজন লোহার রড দিয়ে পিটিয়েছে। জ্ঞান হারানো নবীকে তারা মৃত ভেবে পাশের একটি ভবনের বাউন্ডারি গেটের ভেতর নিয়ে কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখে। সেখানে আরও অনেককে এভাবে রেখেছিল। পরে জ্ঞান ফেরার পর বাড়ির লোকজনকে ডাক দিলে তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাত ৮টার দিকে খবর পেয়ে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজে গিয়ে নবী হোসেনকে পাই। শরীরে তার পাঁচ শতাধিক ছররা গুলি দেখতে পাই। এ ছাড়া দলীয় ক্যাডারদের রডের আঘাতে তার শরীরে বড় বড় গর্ত হয়ে আছে।
জামাল মিয়া আরও বলেন, ‘ভয়ে হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সামান্য চিকিৎসা দিয়েই রাতেই ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করে দেন নবী হোসেনকে। রাস্তায় তখন পুলিশ আর ছাত্রলীগে লোকজন ভর্তি। নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কোনো অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছিল না। সবার মধ্যে আতঙ্ক। শেষে গাজীপুর থেকে উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান ১৩ হাজার টাকায়। বেসরকারি হাসপাতালে দুই দিন আইসিইউতে রাখা হয়। এই দুই দিনে বিল আসে এক লাখ টাকা। গ্রাম থেকে সুদে টাকা এনে বিল পরিশোধ করে ৮ আগস্ট নিয়ে আসি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে।’সুদ-ঋণের টাকাও শেষ; তাই সেখানে দু-তিন দিন চিকিৎসা শেষে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যান। কিন্তু তিন-চার দিন পর ব্যথা শুরু হলে বারহাট্টা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। তাতে কোনো উন্নতি হয়নি ব্যথা আরও বেড়ে চলে। পরে গত ২২ আগস্ট ফের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে শেষে ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সেখানেই রয়েছে নবী হোসেন। তবে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না সে। এখন পর্যন্ত চিকিৎসায় খরচ হয়েছে প্রায় তিন লাখ টাকা। নবী হোসেনের চিকিৎসায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি বলে জানান তিনি। জামাল মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, ‘বারহাট্টা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ময়মনসিংহ নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আর কেউ এখনো কোনো সহযোগিতা করেননি। আমরা গরিব মানুষ, নবী হোসেন আহত হয়ে থাকায় আয়ের পথ বন্ধ। উল্টো তার পেছনে প্রায় তিন লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। সব টাকাই সুদে আনা। আর কত দিন যে লাগে তার সুস্থ হতে, একমাত্র আল্লাহই জানেন। আমি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি তারা যেন আমাদের একটু সহযোগিতা করেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

ময়মনসিংহ মহাবিদ্যালয় এর উদ্যোগে গাজায় চলমান গণহত্যার প্রতিবাদে অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ মিছিল

Share the post

Share the postনিউজ রিপোর্ট:৮ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার – ময়মনসিংহ মহানগরের অধীনস্থ ময়মনসিংহ মহাবিদ্যালয় ছাত্রদল গাজায় চলমান ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার প্রতিবাদে একটি অবস্থান কর্মসূচি এবং বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন করে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে তারা বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানায়, গাজায় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে।   মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রদল সদস্যরা সকাল ১১ টার দিকে মিছিলটি শুরু […]

ভালুকায় নিহত শ্রমিকদলনেতার পরিবারকে তারেক রহমানের ঈদ উপহার

Share the post

Share the postআল আমিন, ভালুকা (ময়মনসিংহ) :ময়মনসিংহের ভালুকায় শ্রমিকদলনেতা মরহুম রফিকুল ইসলাম বাচ্চুর পরিবারকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে ঈদ উপহার প্রদান করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) বিকেলে ময়মনসিংহ বিভাগীয় শ্রমিকদলের সভাপতি আবু সাইদ ও ভালুকা উপজেলা শ্রমিকদলের সাধারণ সম্পাদক শাহ মোঃ সুজন ওই উপহার সামগ্রী মরহুম রফিকুল ইসলাম বাচ্চুর পরিবারের কাছে পৌছে […]