করিমগঞ্জ উপজেলায় শ্রেষ্ট জয়িতা সফল জনণী নারী ক্যাটাগরীতে রত্নগর্ভা বেগম হামিদা খাতুন
আকিব হৃদয়, কিশোরগঞ্জঃ আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস ২০২০ উদযাপন উপলক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ জয়িতা অন্বেষণ কার্যক্রম এর আওতায় করিমগঞ্জ উপজেলায় শ্রেষ্ট জয়িতা ও সফল জননী নারী ক্যাটাগরীতে করিমগঞ্জ উপজেলায় শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন বেগম হামিদা খাতুন। আজ বুধবার সকালে করিমগঞ্জ উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে করিমগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন, মহিলা ও শিশু বিশয়ক অধিদফতর এর যৌথ আয়োজনে এ পদক বিতরণ করা হয়। এসময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলিমা নূর হোসেন, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা সুমী সহ স্থানীয় গনমান্য ব্যক্তিবর্গ। বেগম হামিদা খাতুনের সংক্ষীপ্ত জীবন কাহিনী নীচে তুলে ধরা হলো, কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার অজোপাড়া গাঁ কলাবাগে এক মুসলিম পরিবারে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৬১ সনে জন্মগ্রহণ করি। আমার পিতা মরহুম আব্দুল আজিজ, একজন ব্যবসায়ী এবং মাতা মরহুমা ফরমুজা খাতুন একজন গৃহিনী ছিলেন। তাদের পরিবারে আর্থিক দূর্দশা তেমন না থাকলেও পড়াশোনার ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। আমার পৈতৃক বাড়ি হতে মাধ্যমিক স্কুল প্রায় ৪/৫ কিলোমিটার দূরে ছিল। স্কুলে যাতায়াতে রাস্তা ছিল খুবই খারাপ, ছিল না কোন যানবাহন। পরিবারে পড়াশোনার প্রতি খুব বেশি আগ্রহ না থাকার পরেও আমি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং অদম্য ইচ্ছায় ১৯৭৭ সনে বালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, করিমগঞ্জ হতে এস.এস. সি. পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হই। পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকার কারণে পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার বাড়ি হতে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কিশোরগঞ্জ শহরে অবস্থিত গুরুদয়াল সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই। তৎকালীন সময়ে আমার নিজস্ব কোন নিকটাত্মীয় না থাকায় দূরসম্পর্কের এক বোনের বাসায় থেকে পড়াশোনা শুরু করি। কিন্তু ঐ বোনের বড় মেয়ে এক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয় এবং সে প্রায় ৪ মাস হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর সুস্থ হলেও আমার ঐ বোন পরবর্তীতে শহরের বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। শহরে আমার থাকার আর কোন জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে আমাকে গ্রামের বাড়িতে ফেরত যেতে হয়। আমার বাবা ১৯৮০ সনে জনাব দেলোয়ার হোসেন এর সাথে পারিবারিক ভাবে বিয়ে দেন। আমার স্বামীর পরিবার ছিল যৌথ পরিবার। আমি নিজ ইচ্ছায় এবং আমার স্বামীর সার্বিক উৎসাহে ১৯৮২ সনে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা হিসেবে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি এবং ১৯৮৫ সনে চাকুরিতে যোগদান করি। আমার স্বামী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি জনসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। ১৯৮৫ সনে আমার প্রথম সন্তান নুসরাত হোসাইন জনি, ১৯৮৬ সনে আমার দ্বিতীয় সন্তান মোঃ জুলফিকার হোসাইন রনি এবং ১৯৯২ সনে আমার তৃতীয় সন্তান ডাঃ বেনজীর হোসাইন সনি জন্মগ্রহণ করে। আমার চাকুরী হলেও প্রায়শই বেতন অনেকদিন পরপর পাওয়া যেত। কারণ তখনও আমাদের চাকুরী রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হয়নি। আমার স্বামী স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হলেও অর্থের মোহ তাকে তার নৈতিকতা হতে বিচ্যুত করতে পারেনি। আমরা পারিপার্শ্বিকভাবে আর্থিক চাপে থাকলেও সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই যতœশীল ছিলাম। আমি চেয়েছি আমার সন্তানগুলোর পড়াশোনার পরিবেশ কোনভাবেই বাধাগ্রস্ত যেন না হয়। আমি বিশ্বাস করতাম পড়াশোনার মাধ্যমেই একজন মানুষ নিজের অবস্থানকে পরিবর্তন করতে পারে। আমার উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে যতগুলো অন্তরায় ছিল আমার সন্তানদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে সে অন্তরায়গুলো রাখব না মর্মে আমি মনে মনে পণ করি। সন্তানদের ভবিষ্যত মঙ্গলের কথা চিন্তা করে আমি এবং এবং আমার স্বামী ১৯৯৬ সনে গ্রামের বাড়ী হতে কিশোরগঞ্জ শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে থাকি এবং সন্তানদেরকে শহরের স্কুলে ভর্তি করি। শত আর্থিক দৈন্যতা সত্তে¡ও সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দেইনি। প্রয়োজনে নিজের মনের সকল স্বাদ-আহ্লাদ/ইচ্ছা/চাহিদাকে বিসর্জন দিয়েছি। সন্তানদের যে কোন সৃজনশীল কাজগুলোকে আমি সবসময় উৎসাহ প্রদান করেছি। মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আমার প্রথম সন্তান নুসরাত হোসাইন জনি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হতে নৃ-বিজ্ঞানে ¯œাতক এবং ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছে। বর্তমানে সে স্বামীর সাথে সুইডেনে অবস্থান করছে। আমার দ্বিতীয় সন্তান মোঃ জুলফিকার হোসাইন রনি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন বিভাগে ¯œাতক এবং ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছে। বর্তমানে সে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসে সিনিয়র সহকারী জজ হিসেবে শেরপুরে কর্মরত আছে। আমার পুত্রবধু ফারিন ফারজানা, সেও বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে শেরপুরে কর্মরত আছে। আমার তৃতীয় সন্তান ডাঃ বেনজীর হোসাইন সনি, জালালাবাদ রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জন করে বর্তমানে বেসরকারী আব্দুল হামিদ মেডিকেল কলেজে লেকচারার হিসেবে কর্মরত আছে। পাশাপাশি প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করছে। আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষিত ব্যক্তি রাষ্ট্রের কি সমাজের কি পরিবার কি তার নিজের জন্য সম্পদ। আমার ব্যক্তি জীবনে পড়াশোনা শেষ করতে না পারার যে অপূর্ণতা ছিল, আমি আমার সামর্থ্যরে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সন্তানদেরকে নিজ পরিচয়ে পরিচিত করার চেষ্টা করেছি। সন্তানদেরকে নিজ পরিচয়ে পরিচিত করতে যেয়ে আজও আমি ভাড়াটিয়া। এতে আমার নূন্যতম দুঃখবোধ নেই। আমি দেশের প্রতিটি মাকে বলতে চাই একটি উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। একজন মা-ই পারেন সন্তানদেরকে সুশিক্ষায় গড়ে তুলতে।