উপকূলীয় জমিতে সূর্যমুখী চাষের নতুন সম্ভাবনা
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় এমনই এক ইতিবাচক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। ব্র্যাক জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির উদ্যোগে ও সহায়তায় লবণসহিষ্ণু সূর্যমুখী চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে হাইসান-৩৩ জাতের সূর্যমুখী বীজ এই অঞ্চলের কৃষকদের জন্য আশাতীত ফলন দিচ্ছে। এই উচ্চফলনশীল জাতের সূর্যমুখী চাষ করে কৃষকরা একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পথও তৈরি হচ্ছে।
এক সময় এই অঞ্চলে আমন ধান কাটার পর অধিকাংশ জমি পতিত পড়ে থাকতো, কারণ লবণাক্ততার কারণে অন্যান্য শস্য চাষ করা সম্ভব হতো না। কিন্তু ব্র্যাকের এডাপটেশন ক্লিনিকের সহায়তায় কৃষকদের বীজ, সার, বালাই ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়, যার ফলে তারা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সূর্যমুখী চাষে আগ্রহী হন। এর ফলস্বরূপ, এই বছর কলাপাড়ার প্রায় ৫,০০০ বিঘা পতিত জমিতে সূর্যমুখী চাষ করা হয়েছে, যা থেকে ১,৮০০ টন সূর্যমুখী উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই উৎপাদিত সূর্যমুখী থেকে প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজার লিটার তেল পাওয়া যাবে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
সূর্যমুখী বীজের তেল পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ এবং এতে কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকে, ফলে এই তেলের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয়ভাবে কৃষকদের যাতে তেল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ করতে সুবিধা হয়, সেজন্য তাদের মধ্যে সূর্যমুখীর খোসা ছাড়ানোর মেশিন এবং তেল ভাঙানোর মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। কৃষকরা এখন শুধু সূর্যমুখী বীজ বিক্রিই করছেন না, বরং স্থানীয় বাজারে ২৫০ টাকা লিটার দরে তেলও বিক্রি করছেন। এই উদ্যোগ উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
লতাচাপলি ইউনিয়নের তাহরেপু এলাকার কৃষক রাবেয়া বেগম জানান, “লবণাক্ত মাটিতে এত ভালোভাবে আর কোনো ফসল ফলতে দেখিনি। প্রতি একরে প্রায় ২৭-৩০ মণ সূর্যমুখী বীজ সংগ্রহের আশা করছি। আগে যেখানে মুগ ডাল উৎপাদন করতাম, সেখানে এখন সূর্যমুখী চাষ করে পাঁচগুণ বেশি আয় করছি। সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো, এখন আর বাজার থেকে তেল কিনতে হয় না। গবাদি পশুর খাদ্যের জন্যও সূর্যমুখীর ডালপাতা কাজে লাগছে।”
একই এলাকার আরেক কৃষক হাশেম মুন্সি বলেন, “সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতার কারণে এবার আমাদের ফসল ভালো হয়েছে। এটি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, নগর উন্নয়ন কর্মসূচি ও দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. লিয়াকত আলী বলেন, “উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ও সঠিক পরামর্শের মাধ্যমে লবণাক্ত জমিতে সূর্যমুখী চাষ একটি বিপ্লব ঘটাতে পারে। এটি শুধু কৃষকদের জন্য নয়, বরং স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে।”
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৪০ কোটি টাকার সূর্যমুখী তেল উৎপাদনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।”
উপকূলীয় অঞ্চলে লবণসহিষ্ণু সূর্যমুখী চাষ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। এটি কৃষকদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে এবং ভবিষ্যতে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।