ফেইসবুকে লিডিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষকের মে দিবসে স্মৃতিচারণে শ্রদ্ধা নিবেদন।

Share the post

আমি একসময় শ্রমিক ছিলাম। সাসেক্স ইউনিভার্সিটিতে এম.এস.সি করার সময় টিউশন ফিসের জন্যে পেট্রোল পাম্পে কাজ করতাম ভোর ৬টা থেকে, পাশাপাশি একটা গুদামে শ্রমিকের কাজ করতাম, আবার উইকএন্ডে রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করতাম। রাতে বাসায় ফিরতে ১টা বেজে যেতো। শ্রমিক হিসেবে ২০/২৫ কেজি ওজনের চালের বস্তা, পিয়াজের বস্তা বইতে হতো, দূরে কোথাও কোনো রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দিতে হতো। আবার রাতে ঐ জায়গাগুলো থেকে পেমেন্টের টাকা আনতে হতো। ভীষণ সাইনোসাইটিসের সমস্যা নিয়েও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ফ্রিজরুমে কাজ করতে হতো। বিলেতে কাউন্টারে যখন সেলসম্যানের কাজ করেছি তখন সেরা সেলসম্যান হতে চেয়েছি। রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজে যে অনেকটা মেধা কাজে লাগাতে হয় তা নিজে ওয়েটার না হলে জানাই হতো না। মন খারাপের সন্ধ্যাবেলায় হাসিমুখে কাস্টমারের অর্ডার আনা চাট্টিখানি কথা না। পড়ালেখার পাশাপাশি এতো কাজ করেও আমার কখনো নিজেকে ছোটো মনে হতো না। কাজ যেমনই হোক, আমি করতাম সর্বোচ্চ সততা নিয়ে। টিউশন ফিসের টাকা দেশে চেয়ে মা-বাবাকে বিপদে ফেলবার চাইতে নিজে কাজ করে উপার্জন করাই আমার কাছে ভালো মনে হতো। আমার নানা-নানী, মামা-মামীদের সবাই ওখানে। আমার নানাভাই ছিলেন বটগাছের মতো। আর আমার তিন মামা এবং তিন মামী, তাদের কোনো তুলনাই হয় না। রমজান মাসে ইফতারের সময় পেট্রোল পাম্পে ছুটি ছিলো না। আমার ছোটমামী বাইরে থেকে শক্ত আর মনটা একদম নরম। ছোটমামী নিজে ইফতার না করে অনেকটা পথ হেঁটে এসে আমায় ইফতার পৌঁছে দিতেন- এই ঋণ কেমন করে শোধ করি? এক কাজ থেকে অন্য কাজে যাওয়ার ফাঁকে সময় থাকতো কম। বড়মামী আমার সময় বাঁচানোর জন্যে গোসলের পানি গরম করে দরজায় দাঁড়িয়ে রইতেন। গোসল করে বের হলে প্রায়ই নতুন জামা টেবিলে গুছিয়ে রাখতেন। আর আমার নানু, পৃথিবীর সেরা নানু। আমি তাকে দিদি বলে ডাকি। দিদি প্রতিদিন একলা ঘরে শুধু আমার জন্যে মজার মজার রান্না করে পথের দিকে চেয়ে রইতেন। আমার সব রাগ-অভিমান চলতো এই দিদির উপর তবু দিদি কখনো বিরক্ত হতেন না। দিদি বিলেতে না থাকলে আমার কখনো মাস্টার্স করা সম্ভবই হতো না। তাদের সাথেই থেকেছি, অনেক অনেক আদর-যতন আর সাহায্য পেয়েছি। তবে যখনই তারা আমার টিইশন ফিস দিতে চেয়েছেন, আমি বিনয়ের সাথে না করেছি। এই টাকাটা আমি নিজের শ্রম দিয়ে কাজ করেই আয় করেছি। ২০০৫ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে ছিলাম। তখন মানুষ লন্ডন থাকতে চাইতো যেকোনো মূল্যে, কিন্তু সেই সময় আমি দেশে চলে এসেছিলাম, স্বেচ্ছায়। ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী ছিলো, ভালো চাকুরি ছিলো, অনেক টাকার হাতছানি ছিলো, ব্রিটিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিলো কিন্তু এসব কিছুই আমায় টানেনি, যতোটা টেনেছিলো আমায় আমার দেশ। সীমিত সামর্থ্যের মাঝেই দেশের কাজ করতে চেয়েছি। আমার ছাত্র-ছাত্রীকে কম্পিউটার সায়েন্স কিংবা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কঠিন বিষয়গুলো সহজ করে বুঝানোর চেষ্টা করেছি। ক্লাসে হাসিখুশি থেকে পরীক্ষার হলে কড়া হয়েছি। পড়ার ফাঁকে সময় যখনই পেয়েছি- সহজ ভাষায় দেশকে ভালোবাসা শিখিয়েছি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শিখিয়েছি, মা-বাবাকে সম্মান করতে বলেছি আর সকল রকম শ্রম এবং শ্রমজীবী মানুষকে মর্যাদা করা শিখিয়েছি। বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা উঠিয়ে কর্মহীন মানুষকে পরিশ্রমের করে কর্মসংস্থানের পথ দেখানোর চেষ্টা করেছি। নিজের শ্রম দিয়ে কি করে স্বাবলম্বী হওয়া যায়- সেই পথ বাতলে দেওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছি। আজ ১লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে ওই শহরের হে’ মার্কেটের শ্রমিকরা। মিছিলে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় পুলিশ। এতে ১১ শ্রমিক নিহত হন। আহত ও গ্রেফতার হন আরও বহু শ্রমিক। পরে প্রহসনমূলক বিচারে ৬ জন শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এতে বিক্ষোভ আরও প্রকট আকার ধারণ করে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। পরবর্তীতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৯০ সাল থেকে দিনটি ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সবাইকে অনুরোধ, প্রতিটা শ্রমিকের প্রতি ফোঁটা ঘামের মর্যাদা দিতে শিখুন। রিকশাচালক, দিনমজুর, চা-য়ের দোকানের পিচ্চি ছেলেটা, বাসার কাজের মেয়েটা, ড্রাইভার, দোকানের সেলসম্যান, অফিসের পিয়ন, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার কিংবা এমন পেশার মানুষদেরকে ছোটো করে না দেখে তাদের দীর্ঘশ্বাস শুনুন। তাদের সাথে জবরদস্তুি না করে আবেগ নিয়ে কাজ করুন। কঠিন করে শক্ত কথা না বলে ভালোবেসে হাসিমুখে কথা বলুন। ভদ্র পোশাকের আমাদের চাইতে ময়লা কাপড়ের ওরাই হয়তো বেশি সৎ। হয়তো আমাদের আয়ের চাইতে তাদের আয়টুকু সৃষ্টিকর্তার কাছে বেশি পছন্দের। হয়তো তাদের সাথে উত্তম ব্যবহারের কারণে হাশরের মাঠে শেষ বিচারের দিন আপনি-আমি হবো সৌভাগ্যবান। সকল শ্রমজীবী ভাই-বোনদের জন্যে অনেক শ্রদ্ধা… লেখক: রুমেল এস এম পীর সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, লিডিং ইউনিভার্সিটি, সিলেট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

শায়েস্তাগঞ্জে নারী ও শিশু মামলায় আসামী গ্রেফতার!

Share the post

Share the postস্বপন রবি দাশ,হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি: হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামী মোঃ কাওছার মিয়া কে গ্রেফতার করেছে শায়েস্তাগঞ্জ থানা পুলিশ। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গতকাল শনিবার রাতে নোয়াগাঁও(বাখরপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে শায়েস্তাগঞ্জ মডেল থানায় নিয়ে আসেন। গ্রেফতারকৃত আসামী হলো- শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাঁও(বাখরপুর) গ্রামের মৃত আছকির মিয়ার পুত্র মোঃ […]

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা ওভারব্রিজ থেকে ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা ছিনতাই

Share the post

Share the postসিলেট প্রতিনিধি : সিলেট শহরের দক্ষিণ সুরমার কদমতলি ওভারব্রিজ এলাকায় আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক গোলাপগঞ্জ শাখার সহকারী ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। জানা যায়, শাহিন নামের এক ব্যক্তির নিকট থেকে মঙ্গলবার (১ অক্টোবর)  বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকার কদমতলী ওভারব্রিজ থেকে ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা ছিনতাই নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় […]