পাবনার ঈশ্বরদীতে মাদক ও নগ্নতায় ভরপুর চলছে স্বপ্নদ্বীপ রিসোর্ট।
বিশেষ প্রতিনিধি, পাবনা: মাদক, আর নগ্নতায় ভরপুর ঈশ্বরদীর জয়নগর স্বপ্নদ্বীপ রিসাের্ট। সম্প্রতি রিসাের্ট নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হলে নানা আলােচনা-সমালোচনার জন্ম হয়। এর পরই সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে চালানাে হয় অনুসন্ধান। সেই সব অনুসন্ধানে এসব নেতিবাচক তথ্য উঠে এসেছে। বিভিন্ন সূত্র ও স্থানে এলাকাবাসীরা জানান, স্বপ্নদ্বীপ রিসোর্ট প্রতিনিয়ত মদ, নারী ও মাদক ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বিতর্কিত ব্যক্তিদের অসামাজিক কার্যকলাপ ও উচ্চ শব্দের ডিজে পার্টির কারণে এলাকার পরিবেশ চরমভাবে নষ্ট হচ্ছে। রুপপুর প্রকল্পে কর্মরত দেশী-বিদেশী নাগরিক, শিক্ষার্থী ও উচ্চ বিত্তের তরুণ-তরণীরা রিসাের্ট কর্তৃপক্ষের খপ্পরে পরে বিপুল অঙ্কর টাকা কামানোর ঘটনা এখন নিত্যদিনের। অভিযােগ রয়েছে, এই রিসোর্ট মালিক বর্তমানে তিনি ভাল (ভূমিকা) পাল্টিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বপ্নদ্বীপ রিসাের্টের মালিক আলহাজ্ব খায়রুল ইসলাম বিগত কয়ক বছর আগেও জয়নগর শিমুলতলা এলাকার একজন ট্রাক বদবস্তকারী ছিলেন। পরবর্তীতে চাউল ব্যবসার কমিশন এজেন্ট হয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর টাকা মেরে শিল্পপতি বনে যান। বিপুল পরিমাণ ব্যাংক লােন আর ওই সময়¯ ব্যবসায়ীদের টাকায় তিনি একের পর এক গড়ে তােলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন স্বপ্নদ্বীপ রিসাের্ট। এর মধ্যেই ফ্রিডম পার্টির নেতা ঈশ্বরদীর আলাচিত এক ধনার্ঢ্য ব্যক্তির শীর্ষত্ব গ্রহণ করেন তিনি। এরপর আর খায়রুল ইসলামকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ওই ব্যক্তির সার্বিক সহযাগীতায় তিনি ফুল-ফেঁপে বড় হতে থাকেন। নিজের উত্থান সম্পর্কে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খায়রুল ইসলাম গর্ব করেই বলেন “আমার জন্মদাতা পিতা আমার জন্য যা করেনি, (নাম উল্লেখ করে ও দেখিয়ে বলেন) এই ব্যক্তি আমার জন্য তাই করেছেন। তিনি আমার “আব্বা”। সূত্র জানায়, ফ্রিডম পার্টির ওই নেতার পরিচয়ে খায়রুল ইসলাম ঈশ্বরদীসহ আশেপাশের এলাকায় নিটল-নিলয় গ্রুপের ট্রাক বিক্রয়, জমি ক্রয়সহ বিভিন্ন কাজের মধ্যে¯তাকারী হিসেবে কাজ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বপ্নদ্বীপ রিসাের্টের একাধিক সূত্র জানান, মদ বিক্রয়ের সরকারী বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কােন অনুমোদন নেই স্বপ্নদ্বীপ রিসোর্টের । তারপরও দেশী-বিদেশী মদ এই রিসাের্টে বিক্রয় করা হয়। স্বপ্নদ্বীপ রিসাের্টের অপর একটি সূত্র জানায়, গত বছর ইংরেজী বছর উদ্যাপনক কেন্দ্র করে রাজশাহী থেকে বিভিন্ন মাদক দ্রব্য আনার সময় গাড়িসহ খায়রুল ইসলাম রাজশাহীর এক থানায় আটক হন। সেই সময় খায়রুল ইসলাম ওই থানায় দুই লাখ টাকার দরকষাকষি শুরু করেন। তখন থানায় রিসাের্টের রন্ধনকারী ও খায়রুল ইসলামের পিএসসহ চালককে আটক করে বসিয়ে রাখা হয়। আটককৃত মাদক দ্রব্যগুলাে রাশিয়ানদের উল্লেখ করে থানায় রাশিয়ানদের পাসপাের্টের কপি ইমেইল করে পাঠানা হয়। একই সঙ্গে প্রশাসনের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সুপারিশ বশে কিছু টাকার বিনিময়ে মাদক দ্রব্যসহ সকলকে ছাড়িয় আনা সম্ভব হয়। জনশ্রুতি রয়েছে , পার্শ্ববর্তী নাটার, কুষ্টিয়া, যশাের, ঢাকা, চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কম বয়সী মেয়েদের (কল গার্লদের) রিসাের্টে এনে অসামাজিক ব্যবসা করানাে হয়। সূত্র জানায়, এই রিসাের্ট একটি লাক্সারি ভবন রয়েছে। যেখানে ১০টি রুম রয়েছে। প্রতিটি রুম এক রাতের জন্য কাস্টমারদের ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এই ব্যয়বহুল রুমগুলা রপপুর প্রকল্প কর্মরত উচ্চ শ্রেনীর রাশিয়ানসহ দেশের সরকারী, বেসরকারী হাইপ্রােফাইলের লােকজনের নামে বরাদ্দ থাকে। এতে প্রতিদিন রুমগুলা থেকে উপার্জন হয় দেড় লাখ টাকা। প্রতিদিন এত টাকা উপার্জন হওয়ায় রিসাের্ট মালিক বর্তমান তাঁর অন্যান্য ব্যবসার চেয়ে রিসাের্ট ব্যবসার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছেন বলেও জানায় ওই সূত্রটি । তবে জনবসতি এলাকায় রিসাের্ট হওয়ায় এলাকাবাসীরা পড়ছেন চরম বেকায়দায় । সারারাত রিসাের্টে মদ পান আর উচ্চ শব্দের ডিজে পার্টির নামে অর্ধ উলঙ্গ নৃত্য, হইহুল্লোড় । আর বিশেষ বিশেষ দিবসে উচ্চ শব্দের বাজি ফাটানোও মারাক্তক ঝুকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের। এলাকার ধর্মপ্রাণ মানুষ এভাবে উচ্চ শব্দ ডিজে পার্টি না করার জন্য রিসাের্টে এসে অভিযােগ করেন। কিন্তু রিসাের্ট মালিক প্রতাবশালী হওয়ায় সব অভিযােগ কর্নপাত করছেন না। আর এখানে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের লােকজনসহ প্রভাবশালী নেতাদের চলাফেরা থাকায় এলাকাবাসী বর্তমানে অভিযােগ করাও বন্ধ করে দিয়েছেন বলেও সূত্র গুলাে দাবী করেন। এদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যমে স্বপ্নদ্বীপ রিসাের্ট সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নড়াচড়া শুরু হয়। রিসাের্ট মালিক খায়রুল ইসলামের অতিত ও বর্তমান রাজনৈতিক পরিচয় এবং কর্মকান্ড সম্পর্কে খােঁজ নিতে মাঠে নেমেছেন তারা। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র জানায়, খায়রুল ইসলাম আওয়ামীলীগ অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন। তিনি এর আগে বিএনপির পদধারী নেতা ছিলেন। তার আপন মামা আতিয়ার রহমান ঈশ্বরদী বিএনপির একজন অন্যতম নীতি নির্ধারক, ঈশ্বরদী উপজলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও বিএনপি সমর্থিক ছলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। একই সাথে রিসাের্ট মালিকের ছােট ভাই আমিরুল ইসলাম রিংকু’র শ্বশুরও তিনি। সূত্র জানায়, রুপপুর প্রকল্প কর্মরত রাশিয়ানদের টার্গেট করে খায়রুল ইসলাম নির্মাণ করেছেন স্বপ্নদ্বীপ রিসাের্ট। স্বপ্নদ্বীপ রিসাের্ট ও হাটল উদ্বোধনের পর থেকেই সেখানে দেশী-বিদেশী নারী পুরুষের অশ্লীল নৃত্য, মদ সরবরাহ শুরু হয়। চালুর কিছুদিন পর গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি রিসোর্টটি অানুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করে। সেই অনুষ্ঠানে খায়রুল ইসলাম মাইকে সকলের সামনে দম্ভের সাথে বলেন, “বাহিরে সমালোচনা করে আমার কি করবেন? আমি রাশিয়ানদের পকেট থেকে টাকা বের করার জন্যই এই রিসাের্ট করেছি। টাকা নিয়ে তাদের রাশিয়া ফিরে যেতে দিব না”। সে সময় তিনি প্রশাসনের বিরুদ্ধেও ব্যাপক সমালোচনা করেন।
এসব তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যে উঠে এসেছে বলেও সূত্রগুলো দাবী করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, রিসোর্টের মালিক প্রতিনিয়ত মদ সংগ্রহ করে পরিবেশন করে আসছে রাশিয়ানসহ রুপপুর প্রকল্পের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের কাছে। রিসাের্টে মদ ও নারী সরবরাহর জন্য রয়েছে তাদের একাধিক দালাল চক্র। এরা ঢাকা, চট্টগ্রাম , রাজশাহীসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণ ও তরণীদের নিয়ে আসার পর হাটল রাতভর উন্মুক্ত নেশায় তাদের দিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ করানাে হয়। তাদের মনারঞ্জনের জন্য বিপুল অঙ্কর টাকা নেওয়া হয়। এছাড়াও কিছু দােভাষী রাশিয়ান শ্রমিক রিসাের্টের কক্ষ ভাড়া নিয়ে ওই সময়¯ পতিতাদের নিয়ে রাতভর আমাদ ফুর্তি করে। শুধু তাই নয়; রিসাের্টে রাশিয়ানদের হাত হয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামীদামী মদ চলে যাচ্ছে স্থানীয় লােকজনদের হাতে। এক শ্রেনীর অপরাধী রিসাের্টে এসে রাশিয়ান নাগরিকদের মাঝে সরবরাহ করছে ফেন্সিডিল, ইয়াবা ও গাঁজাসহ বিভিন মাদকদ্রব্য। এতে চরমভাবে নষ্ট হচ্ছে এলাকার সামাজিক পরিবেশ। রিসোর্টটিতে অসামাজিক কার্যকলাপ চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় রয়েছে স্থানীয় এলাকাবাসী। এদিকে ¯স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয় রিসাের্ট মালিক খায়রুল ইসলামকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হলেও সেখানে থেমে নেই অসামাজিক কার্যকলাপ। এলাকাবাসী জানতে চান, এত কিছুর পরও খায়রুল ইসলামের অবৈধ ও অসামাজিক কার্যকলাপের উৎস কি? মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঈশ্বরদী সার্কেলের (খ) ইনচার্জ (পরিদর্শক) মোঃ সানোয়ার হোসেন জানান, খায়রুল ইসলামের স্বপ্নদ্বীপ রিসাের্ট মদ বিক্রয়ের কোন অনুমােদন নেই। সেখানে মদ বিক্রয় করার খবর পেয়েছি। অবৈধভাবে মদ বিক্রয়ের বিষয় নজরে রাখা হয়েছে বলেও দাবী করেন এই কর্মকর্তা। ঈশ্বরদী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আসাদুজ্জামান বলেন, স্বপদ্বীপ রিসাের্টের বিষয় অনৈতিক নেতিবাচক তথ্য তাদের কাছ এসেছে। সেই তথ্য বিশ্লেষণসহ সময়মত পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ ফিরাজ কবির জানান, স্বপ্নদ্বীপ রিসাের্ট সম্পর্কে খােঁজ-খবর রাখা হচ্ছে । অনেক তথ্য ও এসেছে তাদের কাছে। অবৈধ কাজ সেখানে করতে দেওয়া হবে না। তিনি যত বড়ই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হােক না কেন প্রমাণ সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।