নেত্রকোনায় বিলুপ্তির পথে কৃষিউপকরণ লাঙ্গল

Share the post
সোহেল খান দূর্জয়,নেত্রকোনা প্রতিনিধি: নেত্রকোনায় হাওর অঞ্চলে  কৃষিকাজে ফসলি জমিতে প্রাচীন উপকরণ লাঙ্গল জোয়াল মই চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। হাওর পাড়ের অধিকাংশ মানুষ কৃষি কাজের সাথে জড়িত। কৃষিকাজে কামারের তৈরি এক টুকরো লোহার ফাল আর কাঠমিস্ত্রির হাতে তৈরি কাঠের লাঙল, জোয়াল, খিল, শক্ত দড়ি আর নিজেদের বাঁশের তৈরি মই ব্যবহার করে জমি চাষাবাদ করতেন গ্রামঞ্চলের কৃষকরা।
বারহাট্টা উপজেলার সাহতা গ্ৰামের চাষী কালাম জানান, কৃষিকাজে ব্যবহৃত এসব স্বল্প মূল্যের কৃষি উপকরণ এবং গরু দিয়ে হালচাষ করে এ অঞ্চলের মানুষ যুগের পর যুগ ধরে ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা হয়, অন্যদিকে কৃষকের অর্থ ব্যয় কম হয়। ফসলের পাশের কিংবা ঘাসপূর্ণ জমিতে হালচাষের সময় গরু যাতে কোনো খাদ্য খেতে না পারে, সেদিক লক্ষ্য রেখে পাট, বেত, বাঁশের কঞ্চি অথবা লতাজাতীয় এক ধরণের গাছ দিয়ে তৈরি গোমাই, তুরি (অনেকে ঠুসি নামে চেনেন) গরুর মুখে বেঁধে দেওয়া হয়। আর তাড়াতাড়ি হাল চালানোর জন্য ব্যবহার করেন বাঁশের বা শক্ত কোন লাঠি দিয়ে তৈরি পাচুনি (লাঠি)। এটি খুব বেশি দিনের কথা নয়, কয়েক বছর আগে এসব গরুর হালে লাঙ্গল-জোয়াল আর মই  জেলার বিভিন্ন গ্রামের জমিতে হরহামেশাই দেখা যেত।
নেত্রকোনার চাষী নজরুল ইসলাম বলেন,অনেক চাষী নিজের জমিতে হালচাষ করার পাশাপাশি অন্যের জমি চাষিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু অর্থও উপার্জন করতেন। তারা হাজারো কর্মব্যস্ততার মধ্যেও কখনো কখনো ফুরফুরে আনন্দে মনের সুখে ভাওয়াইয়া,পলি­গীতি ও ভাটিয়ালী গান গেয়ে গেয়ে জমিতে চাষ দিতেন। এখন হাতে গোনা দু-একজন কৃষককে পাওয়া যায়। আর চাষ কাজের জন্য হালের গরু ছোট থাকা কালীন পোষ মানাতে বেশ কিছুদিন সময় লাগতো। ভোররাত থেকে শুরু করে প্রায় দুপুর পর্যন্ত জমিতে হালচাষ করতেন তারা। চাষিরা জমিতে হাল নিয়ে আসার আগে চিড়া-গুড় অথবা মুড়ি-মুড়কি দিয়ে হালকা জল খাবার খেয়ে নিতেন।
খালিয়াজুরীর চাষী হিমেল তালুকদার জানান, হুকা ও পাতা বা কাগজের তৈরি বিড়ি খাওয়া তাদের অভ্যাসে পরিণত ছিল বলে মনে করেন অনেকে। আবার একটানা হট হট, ডাই ডাই, বাঁই বাঁই, বস বস আর উঠ উঠ করে যখন ক্লান্তি আসত, তখন সূর্য প্রায় মাথার উপর খাড়া হয়ে উঠতো। এ সময় চাষিরা সকালের নাস্তার জন্য হালচাষে বিরতি রেখে জমির আইলের ওপর বসতেন। তাদের নাস্তার ধরনটাও ছিল ঐতিহ্যবাহী। এক থালা পান্তা ভাতের সঙ্গে কাঁচা অথবা শুকনো মরিচ, সরিষার খাঁটি তেল আর আলু ভর্তা।
বর্ষাকালে কারো জমির চাষাবাদ পিছিয়ে গেলে সবার শেষে হাল চাষিরা নিজে থেকে হাল গরু নিয়ে এসে পিছিয়ে পড়া চাষিদের জমি চাষ দিতেন। হাল চাষিদের সঙ্গে আরো যোগ দিতেন ধানের রোপার চারা লাগার লোকজন। সকলের অংশ গ্রহণে উৎসবমুখর এই কাজটিকে বলা হতো-‘কৃষাণ’। কৃষ্যাণে অংশ নেওয়া কৃষাণদের জন্য জমিওয়ালা গেরস্থরা বড় বড় মোরগ, হাঁস কিংবা খাসি জবাই করে ভোজ করাতেন। কিন্তু আজকাল সময়ের আবর্তে  জেলা থেকে এসব গরুর হাল, কৃষি উপকরণ কাঠের লাঙ্গল, জোয়াল, বাঁশের মই হারিয়ে যেতে বসেছে এবং হাল-কৃষাণ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বিলুপ্তির কারণ, এ যুগে মানুষের অসীম চাহিদা আর অভাবময় জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া দিতে আবির্ভ‚ত হয়েছে দামি দামি যান্ত্রিক হাল যেমন, কলের লাঙল, ট্রাক্টর। সঙ্গে এসেছে ফসলের বীজ বপন-রোপণ, ঝাড়াই-মাড়াই করার যন্ত্র।
আর এসব যন্ত্র চালাতে মাত্র দু’একজন লোক প্রয়োজন। ফলে বিত্তবান কৃষকরা ওই যন্ত্র কিনে মজুরের ভূমিকায় কাজ করলেও গ্রামের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দিনমজুরের জীবন থেকে ঐ সব ঐতিহ্যময় স্মরণীয় দিন চিরতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আগামী প্রজন্ম হয়তো জানতেই পারবে না এভাবে অতীতে চাষ-কাজ করা  হতো।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

চোরাচালান, মাদক দমন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোন

Share the post

Share the postমোঃ সামিরুজ্জামান, প্রতিনিধি চ্যানেল ২১: বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশের সুবিশাল সমুদ্র, উপকূলীয় এবং নদী তীরবর্তী অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। এ অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, জনগণের জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, চোরাচালান ও মাদক দমন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা থেকে শুরু করে নানামুখী দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে […]

‎নবীগঞ্জে গলায় ফাঁস দিয়ে এক যুবকের আত্মহত্যা

Share the post

Share the post স্বপন রবি দাশ,হবিগঞ্জ প্রতিনিধি: হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের পশ্চিম জাহিদপুর গ্রামের তানভীর আহমেদ (৩০) নামে এক যুবক নিজ রুমে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনি মৃত সিরাজ মিয়ার পুত্র। ‎স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্র জানায়, শুক্রবার রাতের দিকে তানভীর নিজের রুমে ঘুমাতে যান। শনিবার সকাল ৯টার দিকে রুমের দরজা না খোলায় পরিবারের সদস্যরা […]