নেত্রকোনায় পাসপোর্ট অফিস থেকেই ফাঁস হচ্ছে আবেদনকারীদের গোপন তথ্য

Share the post
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, নেত্রকোনায় পাসপোর্ট অফিস থেকেই ফাঁস হচ্ছে আবেদনকারীদের গোপন তথ্য। যদিও পাসপোর্ট অফিসের কোন কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী এই চক্রের সঙ্গে জড়িত, সে বিষয়ে জানা যায়নি। নেত্রকোনা পাসপোর্ট অফিসের বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী ব্যক্তিগত সব তথ্য দিয়ে অনলাইন ফরম পূরণ করে সেটির কপি নিয়ে অন্যান্য সব কাগজপত্রসহ পাসপোর্ট অফিসে জমা দেন আবেদনকারীরা। নেত্রকোনায় পাসপোর্টের গোপন তথ্য ফাঁসকারীর অনেকেই পাসপোর্ট অফিসের আশপাশের কম্পিউটারের দোকান থেকে ফরম পূরণ করেন। আবার অনেকে নিজে বা তার নিজ নিজ এলাকা থেকে ফরম পূরণ করে আনলেও পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী, আনসার, পিয়ন, দালালসহ বিভিন্ন লোকজনের সহযোগিতা নেন। পাসপোর্ট আবেদনের পরে সবার কাছেই পুলিশ ভেরিফিকেশনের ফোন যায়। অনেককেই পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে (এসবিতে) ডাকা হয় পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য। আর এই ভেরিফিকেশনের নাম করে পাসপোর্ট গ্রাহকদের কাছ থেকে ফাঁদ পেতে দীর্ঘদিন ধরে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে থাকা বেশ কয়েকটি দালাল চক্র। সত্যিকারত্যে এই দালালরা (এসবির) কোনো সদস্য বলে দাবি করেছেন পাসপোর্টের গ্রাহকরা।
নেত্রকোনা পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে থাকা লোকজন বলেন, আবেদনকারীদের তথ্য চক্রের সদস্যরা পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, আনসার এমনকি কম্পিউটারের দোকান থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। পরে তারা নিজেদের এসবির কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে ভেরিফিকেশনের নামে টাকা আত্মসাৎ করে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার না করলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলে জানান সচেতন মহল।আরোও জানা গেছে, এই প্রতারক চক্র পাসপোর্ট অফিসে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর, পিয়ন ও আনসার সদস্যের যোগসাজশে পাসপোর্ট অফিস থেকে তথ্য নিচ্ছে। পরে পাসপোর্ট আবেদনকারীদের ডেলিভারি স্লিপে এবং আবেদন ফরমে দেওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করে নিজেদের এসবি অফিসার পরিচয় দিয়ে প্রথমে আবেদনকারীকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (এনআইডি, বিদ্যুৎ বিলের কপি) হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে বলে। পরে কৌশলে বিভিন্ন আবেদনকারীর তথ্যে সমস্যা আছে জানিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। নেত্রকোণা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের হয়রানী ও প্রতারণার অভিযোগ এনে পাসপোর্ট অফিস দালাল মুক্ত করতে জেলা প্রশাসক বরাবর বিগত দিনে লিখিত অভিযোগ করেছেন জেলার সদর উপজেলার শিবপ্রসাদপুর গ্রামের মৃত গোলাম হোসেনের পুত্র মোঃ সাহাব উদ্দিন(৭৫)। জেলা প্রশাসক বরাবর ঐ লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, অভিযোগকারী সাহাব উদ্দিন পবিত্র ওমরা হজ্ব পালন করার উদ্দেশ্যে নেত্রকোণা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ২০২২ সালে মার্চ মাসের ২০ তারিখে ব্যাংকে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। ঐ বছরের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে পাসপোর্ট সরবরাহ দেওয়ার নির্ধারিত তারিখ থাকলেও পাসপোর্ট অফিসের নির্ধারিত দালাল ছাড়া পাসপোর্টের জন্য আবেদন করায় নানা অজুহাতে তাকে পাসপোর্টটি সরবরাহ করতে দেওয়া হয়নি। পাসপোর্টটি না পেয়ে ঐ বছর ১৬ নভেম্বর তিনি আবারো ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে পাসপোর্টের জন্য নতুন করে আবেদন করেন। ঐ সময় অভিযোগকারী বৃদ্ধ সাহাব উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, একসাথে ওমরা হজ্ব করতে যাওয়ার জন্য যারা পাসপোর্টের আবেদন করেছিলাম তারা সবাই দালালদের মাধ্যমে অফিসের বাড়তি টাকার চাহিদা পূরন করে নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট নিয়ে ওমরা হজ্ব করে চলে এসেছেন। আর দালালদের মাধ্যমে অফিসের বাড়তি টাকার চাহিদা পূরণ করতে না পারায় আমাকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়নি। তখন অফিসে পাসপোর্টের জন্য যোগাযোগ করলে তারা বলেন, আমার ফাইল হারিয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে আবারো পাসপোর্টের জন্য আমি আবেদন করেছিলাম। তিনি আরো বলেন, নেত্রকোনায় প্রতিদিন শত শত লোক পাসপোর্ট করতে এসে পাসপোর্ট অফিসে হয়রানী ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে।
নেত্রকোনা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক উম্মে কুলসুম বলেন, প্রতিদিন গড়ে ৩০/৪০ টি পাসপোর্ট হয়। পাসপোর্টের জন্য কম্পিউটারের দোকান অথবা আপনি নিজেও অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন বলে তিনি জানান। সরাসরি নিজে অনলাইনে আবেদন করলে পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিড়ম্বনা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো বিড়ম্বনা নাই। প্রতিটি পাসপোর্টের জন্য দালালদের মাধ্যমে ১ হাজার করে বাড়তি টাকা নেয়া হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা ভূয়া। আমি কোনো দালালের ধার ধারিনা, আপনি আমার সম্পর্কে, আমার ফ্যামিলি সম্পর্কে খবর নেন। আমি নেত্রকোণার লোক। দালালী করার জন্য নিজ জেলায় আসিনাই। আমার যতেষ্ট সুনাম আছে, ডিপাটমেন্ট প্লাস গোয়েন্দা সংস্থার সব জায়গায়। এসব কথা আমাকে বলে কোনো লাভ নাই। যদি প্রমাণ পান লোকসহ নিয়ে আসবেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রায় ১৫-২০টি কম্পিউটার দোকানের ব্যবসা। প্রতিটি দোকানেই দেখা যায় পাসপোর্ট করতে আসা লোকজনের উপচেপড়া ভিড়। আবেদনে প্রত্যেক দোকানের আলাদা সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। পাসপোর্ট অফিসের ভিতরে ১০৫ নাম্বার কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইনে অপেক্ষা করছে পাসপোর্টের জন্য আবেদনকারীগণ। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০ টায় অফিস সহকারী রিয়াজ শুরু করেন আবেদনপত্র যাচাই-বাচাই। আবেদনে সাংকেতিক চিহ্ন চোখে পড়লেই আবেদন সঠিক। সাংকেতিক চিহ্ন না থাকলে কোনো না কোনো ত্রুটি আবেদনে থাকবেই। ত্রুটি সংশোধনের জন্য আবেদন বাতিল করে আবারো নতুন আবেদনের পরামর্শ। অবশেষে দালালদের মাধ্যমে অফিসের বাড়তি চাহিদা পূরণ করে আবেদনে সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করেই রোজিনা নামের বৃদ্ধার আবেদনটি রিয়াজ সাহেবের কাছে সঠিক হলো। রোজিনা আটপাড়া উপজেলার তেলিগাতী গ্রামের মন্নাফ তালুকদারের স্ত্রী। তিনি পবিত্র ওমরা হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে পাসপোর্ট করার জন্য এসেছিলেন নেত্রকোণা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। রোজিনা বলেন, তাদের পরিবারের আরোও ৪ জন ওমরা হজ্ব করার জন্য পাসপোর্ট করেছেন। তারা প্রত্যেকেই পাসপোর্ট করার জন্য ব্যাংকের নির্ধারিত ফি ছাড়াও বাড়তি টাকা পরিশোধ করে আবেদনে সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করেছিল। নিজেদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ভূক্তভোগী একই ধরনের অভিযোগ করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন ট্রাভেলস এজেন্সির পক্ষ থেকে জানান, নেত্রকোণা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২’শতাধিক পাসপোর্ট হয়। আবেদন করার সময় ব্যাংকের নির্ধারিত ফি ছাড়াও অতিরিক্ত ১ হাজার ৫ ’শ টাকা অফিস খরচ বাবদ দিতে হয়। এবিষয়ে জানতে চাইলে নেত্রকোনা পুলিশ সুপার মোঃ ফয়েজ আহমেদ পিপিএম বলেন, নেত্রকোনায় পাসপোর্টের এ বিষয়ে এখনো আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি, তবে বিষয়টি তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি এই প্রতিনিধিকে আসস্ত করেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

নেত্রকোনায় গুলিতে একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান হারিয়ে অকুল পাথারে রাসেলের পরিবার

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : গুলিতে নিহত রাসেল মিয়া। গাজীপুরের মাওনায় মোরগের গাড়িতে হেলপারের কাজ করতেন রাসেল মিয়া (১৯)। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণের জন্য কিশোর বয়স থেকেই এ কাজে যোগ দিয়েছিলেন। গত ৫ আগস্ট বিকেলে মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের পোশাক পরা ভারতীয়দের আটক করে জনতা। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ভগ্নীপতির […]

নেত্রকোনায় বিদ্যালয়ের কাজ না করেই বরাদ্দের টাকা ৫০ লাখ টাকা উত্তোলনের অভিযোগ

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোণা : নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার বরইতলা এন আই খান উচ্চ বিদ্যালয়ের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হলেও প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু হয়নি।২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে উন্নয়ন সংশোধিত বাজেটে ‘ইউনিয়ন পরিষদ উন্নয়ন সহায়তা’ খাতের আওতায় ইউনিয়নের অনগ্রসরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং […]