সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা: নেত্রকোনায় প্রায় এক যুগ আগে এই ফুলটি প্রথম দেখেছিলাম। এখন আবার দেখেছি খুব চমৎকার ফুল এটি। বিক্ষিপ্ত লতায় দু-তিনটি ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো নেত্রকোনার বিভিন্ন সড়কে। চটকদারি রঙের কারণে সেদিন সহজেই আমার দৃষ্টি কেড়েছিলো এই ফুলটি। তারপর ভুলেই গিয়েছিলাম ফুলটির কথা। কয়েক দিন আগে নেত্রকোনা শহর থেকে দুর্গাপুর যাওয়ার পথে একটি রাস্তার পাশে ঝোপের ভেতর আবার ফুলটির দেখা পেলাম। সময়স্বল্পতার কারণে ভালোভাবে দেখা হলো না গাছটি। ছবিও তেমন তোলা হলো না। অবশেষে সব আক্ষেপ মিটল গতকাল। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে নেত্রকোনা থেকে মোহনগঞ্জ যাচ্ছিলাম। এদিকটা নেত্রকোনার শেষ সীমানা, তারপর সুনামগঞ্জ শুরু। ফলে এখানকার ভূগঠনে বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাৎপর্যময়। দুর্গাপুর উপজেলার কোথাও উঁচু, কোথাও সমতল। আবার নিচু কিছু স্থানে জলাশয়ও দেখা গেল। ততটা ঘনবসতি নয়। আমার ভ্রমণসঙ্গী জানালেন, একসময় এসব পথ বেশ দুর্গম ছিল। যাতায়াতের সময় অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হতো। এখন চলাফেরা অনেকটাই নির্বিঘ্ন হয়েছে।
সেইদিন ভোরের স্নিগ্ধতায় দুই পাশের দৃশ্য বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠল। সবুজে মোড়ানো চারপাশ। মোহনগঞ্জ উপজেলার হাওরের পাশ দিয়ে খালপাড়ের একটি নির্জন পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। একটি মোড় ঘুরে ডানে বাঁক নিতেই মনে হলো ব্যতিক্রমী কোনো একটা রং যেন চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। চালককে দ্রুত গাড়ি থামাতে বলি। গাড়ি থেকে নেমে খানিকটা পেছনে এসে যে দৃশ্যের মুখোমুখি হই, তা ছিল কল্পনাতীত। এমন নির্জন একটি স্থানে এই হৃদয়গ্রাহী দৃশ্যের মুখোমুখি হব ভাবিনি। ফুলভর্তি ঝোপের কাছে গিয়ে মুগ্ধতার ঘোর আর কাটে না। এ যেন ফুলের সমুদ্র,ডালপালা,শাখা-প্রশাখা কানায় কানায় পূর্ণ। ফুলের এমন স্নিগ্ধ শোভা দেখে মনটাও ভরে গেল। অনেক দিন পর কোনো দুষ্প্রাপ্য ফুলের অবারিত উচ্ছ্বাস প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হলো। ফুলটির নাম কাবিয়া বা কেপার। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ গ্রন্থের তথ্যমতে, এই গাছ দেশের টাঙ্গাইল ও নেত্রকোনা জেলায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। সে হিসেবে এখানে গাছটির অবস্থান ব্যতিক্রমী কিছু নয়। ব্যতিক্রম হলো, প্রাকৃতিক আবাসে এখনো রীতিমতো লড়াই করে টিকে আছে গাছটি।
কাবিয়া (Capparis zeylanica) বড় ধরনের গুল্মশ্রেণির গাছ, ২ থেকে ৮ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। কখনো কখনো আরোহী বা অনেক দূরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ডালপালা কাঁটায় ভরা। তরুণ অবস্থায় শাখা–প্রশাখা মরিচা বা ধূসর কোমল রোমাবৃত। পাতা সবৃন্তক, ৫ থেকে ২০ মিমি লম্বা, রোমশ, ডিম্বাকার বা উপবৃত্তাকার। ফুল অক্ষীয় সারিতে বিন্যস্ত, সাদা ও সুদর্শন, সাড়ে ৩ থেকে ৫ সেমি আড়াআড়ি, পুষ্পবৃত্ত রোমশ, ফলে অতিরিক্ত স্ফীত এবং ৩ সেমি পর্যন্ত দীর্ঘায়ত। পাপড়ি দেড় থেকে ২ সেমি, সাদা, ভেতরের ১টি লালাভ দাগযুক্ত, যা পরবর্তী সময়ে বেগুনি লালে বিবর্ণ, দীর্ঘায়ত, গোলাকার, কোমল রোমাবৃত, অর্ধ–অখণ্ড বা তরঙ্গিত। পুংদণ্ড গৌরবর্ণ, পরে ফ্যাকাশে লালে পরিবর্তিত, গর্ভাশয় দেড় থেকে ৩ মিমি, রোমশবিহীন, উপবৃত্তাকার বা ডিম্বাকার। ফল বেরির মতো, ১৬ থেকে ৩০ মিমি, উপবৃত্তাকার বা গোলাকার, ফলত্বক কাষ্ঠল ও পুরু। ফুল ও ফলের মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর। পরিপক্ব ফল আহার্য। কাঁচা ফল সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। মূলের বাকল প্রশান্তিদায়ক ও পাকস্থলীর ব্যথানিবারক। বাকল কলেরায়ও উপকারী। পাতা উত্তেজনারোধী, ফোঁড়া ও অর্শরোগে ব্যবহার করা হয়। দুর্গাপুরের আদিবাসীরা মূলের বাকল গুটিবসন্ত ও অণ্ডকোষ স্ফীতি রোগে ব্যবহার করেন। এই আদিবাসীরা কাণ্ডের বাকল থেকে কলেরার ভেষজ ওষুধ তৈরি করেন এবং স্তনের স্ফীত রোগে তাঁরা পাতার লেই প্রয়োগ করেন।