নগর ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে সিটি কলেজ গ্রুপের হানা!
১১ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরের ১৪ ইউনিটের নতুন আহ্বায়ক ও আংশিক কমিটি ঘোষণার কথা জানিয়েছিল মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর।কিন্তু এসব কমিটি নিয়ে ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে নগর ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিট। পদবঞ্চিতরা তো বটেই নগর ছাত্রলীগের সাবেক একাধিক নেতাও কমিটি গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে ইমরান আহমেদ ইমু ও জাকারিয়া দস্তগীরের ভূমিকায় প্রশ্ন তুলেছেন।তাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতার দোহাই দিয়ে ইমরান ও জাকারিয়া নিজেদের পকেট ভারি করেছেন। নগর ছাত্রলীগের সাবেক কোনও নেতার সাথেও তারা পরামর্শ করেননি। শাখা কমিটিগুলোয় স্থান পেয়েছে হত্যা- ধর্ষণ মামলার দায়ে অভিযুক্ত আসামি থেকে শুরু করে অছাত্ররাও।
সবচেয়ে বেশি ক্ষোভের আগুন ধরেছে পাঁচলাইশ থানার আংশিক কমিটি নিয়ে। এ কমিটিতে মীর জিহান আলী খানকে সভাপতি ও মো. হোসেন রবিনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এলাকায় কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবে পরিচিত এই রবিন নগরের হামজারবাগ এলাকায় ছাত্রলীগকর্মী নুরুল আলম রাজু হত্যা মামলার প্রধান আসামী। পাশাপাশি এ দুজনই সরকারি সিটি কলেজ গ্রুপের রাজনীতিতে যুক্ত।কলেজ কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এমইএস কলেজ গ্রুপের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অধিকাংশ নেতার উত্থান পাঁচলাইশ ও খুলশী থানা এলাকা থেকে। এযাবৎকালে এলাকাগুলোয় নগর ছাত্রলীগের রাজনীতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি।
ছাত্রলীগের সাবেক কিছু নেতার প্রশ্ন-পাঁচলাইশ থানার আংশিক কমিটিতে সিটি কলেজের দুইজন ছাত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে নগর ছাত্রলীগ শীর্ষ দুই নেতা কি বার্তা দিতে চাইছেন। তাহলে নগর ছাত্রলীগে এমইএস কলেজ গ্রুপের আধিপত্য কি সিটি কলেজ কেন্দ্রিক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল?
এ প্রসঙ্গে এমইএস কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সদ্য নির্বাচিত কাউন্সিলর ওয়াসিম উদ্দিন বলেন, ‘নগর ছাত্রলীগের বিভিন্ন শাখা কমিটি গঠন নিয়ে তারা (ইমরান ইমু ও জাকারিয়া দস্তগীর) আমাদের সাথে কোনও পরামর্শ করেনি। শুনেছি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের পরামর্শে তারা কমিটি করেছে।’জানা গেছে, ঘোষিত কমিটির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের মায়মুন উদ্দিন মামুন। তারা সড়ক অবরোধ করে টায়ারে আগুন জ্বালানোর পাশাপাশি সভাপতি ইমু ও সাধারণ সম্পাদক দস্তগীরের ছবিতে জুতাপেটাও করেন।
নগর ছাত্রলীগের কিছু নেতার অভিযোগ, ঢাকায় বসে নিজেদের পছন্দের লোক দিয়ে কমিটি ঘোষণা করেছেন নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ঘোষিত কমিটি পাকাপোক্ত করতে পাঁচলাইশ থানা কমিটিতে বসানো হয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতার পছন্দের লোক।
এ প্রসঙ্গে নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি বলেন, ‘থানা কমিটি গঠন নিয়ে ইমু ও দস্তগীর আমাদের সাথে কোনও পরামর্শ করেনি। নগর ছাত্রলীগের রাজনীতি আমিও করেছি। এই বাণিজ্যিক রাজধানীতে কোনও শিল্পপতির কাছ থেকে চাঁদাবাজি করিনি। ইমরান ইমু ও জাকারিয়া দস্তগীর যেখানে টেন্ডারবাজি, যেখানে আর্থিক ফায়দা আছে সেখানেই ছুটছে। কমিটিতে যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আমি তাদের বিষয়ে বলব না। ইমু ও জাকারিয়া দস্তগীরের ভূমিকা নিয়ে আমার প্রশ্ন৷ তারা এ কমিটি নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের দোহাই দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তো সারাদেশের, তারা থানা কমিটিতে আসবে কেন?অভিযোগ আছে, নগরের ১৪টি ইউনিটেই ইমু-দস্তগীর তাদের অনুসারীদের নেতৃত্বে এনেছেন। এরমধ্যে মহসীন কলেজের সভাপতি পদ পাওয়া ব্যক্তির বিরুদ্ধে রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবিসম্বলিত পোস্টার ছেঁড়ার মতো গুরুতর অভিযোগ। চকবাজার থানা সভাপতির বিরুদ্ধে রয়েছে কিশোর গ্যাং চালানোসহ নানা অভিযোগ।
একাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর অভিযোগ, ইমরান আহমেদ ইমু ও জাকারিয়া দস্তগীর ঘোষিত কমিটিগুলোয় নেতা হিসেবে এমন কিছু ব্যক্তি স্থান পেয়েছেন যাদের মধ্যে আছে খুন-ধর্ষণ মামলার আসামিও। আবার অনেকের নেই শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিবাহিত। আর এর জলন্ত উদাহরণ পাঁচলাইশ থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন রবিন। তার বিরুদ্ধে আছে হামজারবাগ এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মী নুরুল আলম রাজু খুনের অভিযোগ। চলতি মাসেই চাঞ্চল্যকর এ হত্যার রায় ঘোষণার কথা রয়েছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরে সরকারি সিটি কলেজ, ওমরগণি এমইএস কলেজ, সরকারি কমার্স কলেজ কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের রাজনীতি যুগযুগ ধরে চলে আসছে তিন ধারায় বিভক্ত হয়ে। যুগ যুগ ধরে মহানগর ছাত্রলীগের অনেকটা নিয়ন্ত্রণ থাকত এমইএস কলেজ কেন্দ্রিক ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে। অতীত ইতিহাসে নগর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের সোনালী অধ্যায় জড়িয়ে আছে। কিন্তু নগরের ১৪ ইউনিট গঠন নিয়ে এমইএস কলেজের সাবেক নেতাদের কথা আমলেই নেননি ইমু-দস্তগীর।
অথচ নগরের চারটি ওয়ার্ডে নির্বাচিত কাউন্সিলর এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন। তারা হলেন- ৭ নং পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবারক আলী, ৮নং শুলকবহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোরশেদুল আলম ও ১৫নং বাগমনিরাম ওয়ার্ড কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন ও ওয়াসিম উদ্দিন। পাঁচলাইশের সাবেক কাউন্সিলর কফিল উদ্দিন খানও এমইএস কলেজকেন্দ্রিক রাজনীতির সৃষ্টি।এমইএস কলেজ কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসা অসংখ্য প্রভাবশালী নেতাও দীর্ঘদিন ধরে নগর ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন । তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- সাবেক কাউন্সিলর আওয়ামীলীগ নেতা মামুনুর রশীদ মামুন, নগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এম আর আজিম, যুবলীগের মসিউর রহমান দিদার, আবু নাসের চৌধুরী আজাদ, নগর ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক আরশেদুল আলম বাচ্চু, যুবলীগ নেতা নবনির্বাচিত কাউন্সিলর ওয়াসিম উদ্দিন, নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান তারেকসহ অনেকেই।
এদিকে পাঁচলাইশের ঘোষিত কমিটি একতরফা সিটি কলেজ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষুব্ধ হয়েছেন এমইএস কলেজ গ্রুপের নেতাকর্মীরা । তারা মনে করছেন এটা তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।বিষয়টি নিয়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে৷ ফলে নগর জুড়ে ইমু-দস্তগীর ঘোষিত কমিটি নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনার আশংকাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউ কেউ।
ইমু-দস্তগীর ঘোষিত কমিটিতে পদবঞ্চিত একাধিক নেতার অভিযোগ, তাদের দাবি কানে নিচ্ছেন না মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদক। উল্টো কমিটি ‘জায়েজ’ করতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের পছন্দের কয়েকজনকে কমিটিতে আনা হয়েছে। এর আগে গতবছর চান্দগাঁও ও ডবলমুরিং থানা ছাত্রলীগসহ বেশ কয়েকটি ইউনিটে কমিটি ঘোষণার পর তা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। যদিও কেন্দ্র থেকে তদন্ত করার কথা বলে সেই সময় পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ওই কমিটিই বহাল থাকে। ১৪ ইউনিটে কমিটি গঠন নিয়ে জ্বলা ক্ষোভের আগুনের মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীরা তিন ইউনিটেই পাল্টা কমিটি ঘোষণা করেছে।
শুক্রবার (৫ মার্চ) রাত ৯ টার দিকে মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।