চকরিয়ায় ভ্যান চাপায় ৫ ভাই নিহত, হাসপাতাল-বাড়িতে আহাজারি
সরোজ সুশীল বার্ধক্যজনিত রোগে ভোগে ১০ দিন আগে পরলোক গমন করেন। তার ৭ ছেলে ও ১ মেয়ে বাবার শ্রাদ্ধ করতে ঘরের আঙিনায় প্যান্ডেল তৈরি করে। বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি) শ্রাদ্ধ আনুষ্ঠান। বাবার শ্রাদ্ধের আগেরদিন মঙ্গলবার (৮ ফেব্রুয়ারি) ভোর ৫ টায় ৭ ভাই ১ বোন ক্ষৌরকর্ম করতে বাড়ির নিকটবর্তী মহাসড়কের পাশে যায়।
সেখানে তারা ক্ষৌরকর্মের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ওই সময় কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামমুখি মালবাহী একটি পিকআপ ভ্যান (মিনি ট্রাক) ৮ ভাই-বোনকে চাপা দেয়। এতে ৩ ভাই ঘটনাস্থলে, ১ ভাই চকরিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়ার পথে ও অপর ১ ভাই চমেক হাসপাতালে মারা যায়। আহত হয় অপর ৩ ভাই-বোন। ১ বোন ২ ভাইকে খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চমেকে নেয়া স্বরণ সুশীল বিকেল সোয়া ৪ টায় মারা যায়।
মঙ্গলবার (৮ ফেব্রুয়ারি) ভোর ৫ টায় হৃদয়বিদারক এ ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট হাসিনা পাড়াস্থ রাস্তার মাথায়।
পিকআপ চাপায় নিহত ৫ ভাই হলেন- মৃত সরোজ সুশীলের ছেলে অনুপম সুশীল (৪৫), নিরুপম সুশীল (৩৮), দিপক সুশীল (৩৬), চম্পক সুশীল (৩৬) ও স্বরণ সুশীল (২৮)।
আহতরা হলেন- রক্তিম সুশীল (৩৫), প্লাবন সুশীল (২৪) ও মেয়ে হীরা সুশীল (২৭)। আহতরা মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে জানান ওই হাসপাতালের ডা. সুমন নাথ। এরা সবাই মালুমঘাট হাসিনা পাড়ার বাসিন্দা।
ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর বলেন, গত ১০ দিন আগে হতাহতদের বাবা সরোজ সুশীল মৃত্যু বরণ করেন। আজ মঙ্গলবার ছিলো তাদের বাবা সরোজ সুশীলের ক্ষৌরকর্ম এবং বুধবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান। ধর্মীয় রীতিনুযায়ী মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে তারা সাত ভাই ও এক বোন ক্ষৌরকর্ম করতে হাসিনা পাড়াস্থ রাস্তার মাথায় যায়।
‘ওখানে তারা ক্ষৌরকর্ম সারতে রাস্তার পাশে দাঁড়ায়। এসময় একটি দ্রুতগামী পিকআপ (মিনি ট্রাক) এসে তাদেরকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলে তিন ভাই চকরিয়া সরকারী হাসপাতালে নেয়ার পথে ১ ভাই ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরেক ভাইসহ ৫ ভাই নিহত হন। অন্য তিন জনকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালে নিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, নিহত ৫ সহোদরের সৎকার করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
কক্সবাজারের চকরিয়ার মালুমঘাট হাইওয়ে থানার ইনচার্জ শাফায়েত হোসেন বলেন, পিকআপ চাপায় নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘাতক পিকআপটি জব্দ ও চালককে আটক করার চেষ্টা চলছে।
স্বজনদের আহাজারি
সরোজ সুশীল মারা গেছেন ১০ দিন আগে। সেই শোক চলছে পরিবারে। এখনো শ্রাদ্ধ হয়নি তার। বাবার শ্রাদ্ধের আগের দিন শোকাবহ সন্তানরা ক্ষৌরকর্মও সারতে পারেনি। তার আগেই ৮ ভাই-বোনের মধ্যেই ৫ ভাই চলে গেলেন পরলোকে। ৯১ সালের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর ঘর-ভিটে হারিয়ে কুতুবদিয়ার সরোজ স্ত্রী ও ৩ শিশু-সন্তানকে নিয়ে চকরিয়ার ডুলাজারাস্থ মালুমঘাটে চলে আসেন। এখানকার হাসিনা পাড়ায় ভিটে কিনে ঘর তৈরি করে বসবাস করে আসছিলেন।
এরমধ্যে আরো ৫ সন্তানের জন্ম হয়। সুখেই কাটছিল তাদের জীবন। কিন্তু ১০ দিন আগে সরোজ মারা গেলে পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। ধর্মীয়রীতিতে বাবার শোক পালন করছিল সন্তানরা। এরই মধ্যে ৫ সহোদর বাবার শোক পালন করতে গিয়ে পিকআপ চাপায় মারা গেলে ওই পরিবারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা।
এ যেন শোকের ওপর মহাশোক ভর করেছে। এ শোক সাগরে পরিবারের সবাই হতবাক। আহাজারি ও আর্তনাদে ভারী হয় শোকের পরিবেশ। হাসপাতালেই নিহতদের মা বানু রানী সুশীল ও নিহত অনুপমের স্ত্রী পপি রানী সুশীলসহ পরিবারের সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। হাসিনা পাড়াস্থ বাড়ির উঠানে সরোজ সুশীলের শ্রাদ্ধের জন্য তৈরি করা প্যান্ডেলে পাড়ার নারী-পুরুষরাও জড়ো হয়। তাদেরও কেউ কেউ কাঁদছিল এবং এক অপরকে ধৈর্য্য ধরার শান্তনা দিচ্ছিল।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চকরিয়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মুকুল কান্তি দাশ শোক প্রকাশ করে বলেন, বাবার মৃত্যুতে ক্ষৌরকর্ম করতে গিয়ে ৫ সহোদরের মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। এটি শুধু দুর্ঘটনা নয় হত্যার সামিল।
ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ক্ষৌরকর্ম করতে ৮ ভাই-বোন সড়কের ওপর নয় পাশেই দাড়িয়ে ছিলেন। পিকআপটি সড়ক ছেড়ে রাস্তার পাশে গিয়েই চাপা দেয় তাদের। এ ঘটনার তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।