আবুমুসা চৌধুরীঃ একজন নৌ-কমান্ডো ও বীর মুক্তিযোদ্ধা

Share the post

নোমান বিন খুরশীদ (চট্টগ্রাম): ৬০ এর দশকে যারা “জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য” জেনে রাজপথে রক্তের হোলি খেলে আগুন উৎপন্ন করেছিল, সোনার ফ্রেমে বাঁধানো চট্টগ্রামের সেই অগ্নি ঋষিদের নাম কীভাবে যেন বিস্মৃতির পলেস্তরায় পড়ে বিবর্ণ হয়ে ধূসর হতে হতে অবশেষে মুছে যাচ্ছে বিস্মৃতি প্রবণতার জন্য বিখ্যাত বাঙালির স্মৃতি থেকে। নৌ-কমান্ডো বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় নদীপথ, সমুদ্রপথ ও বন্দর ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এটি গঠন করা হয়। তাদের হাত ধরে বদলে গিয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের হিসাব-নিকাশ। নৌ-কমান্ডোদের পরিচালিত সবেচেয়ে সফল অভিযান হিসেবে ধরা হয় “অপারেশন জ্যাকপট”। নৌ-কমান্ডোদের মধ্যে একজন সক্রিয় যোদ্ধা আবু মুসা চৌধুরী। অপারেশন জ্যাকপটসহ একাধিক নৌযুদ্ধের সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন তিনি। চট্টগ্রামের বৃহত্তর ফটিকছড়ি উপজেলাতে জন্ম নেওয়া আবু মুসা চৌধুরী মাত্র ১৬বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকছেন তিনি। ১৯৭১সালের ১৫ই আগস্ট। চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ বন্দরে একযোগে বাংলাদেশের নৌ-কমান্ডের প্রথম অভিযান ছিল “অপারেশনজ্যাকপট”। আবু মুসা চৌধুরী ছিলেন অপারেশন জ্যাকপটের সদস্য। তাঁর মতে, “অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যাপক মহরা হয়েছিল। ৭১’র ১৪ই আগস্ট রাতে পরিচালিত অপারেশন জ্যাকপটে চট্টগ্রাম বন্দরে কিছু বার্জ ধ্বংস হয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দর ছিল আমাদের অপারেশন এলাকা।” সেদিন বড় কোনো জাহাজ ধ্বংস না হলেও বেশকিছু ছোট ছোট নৌযান সেদিন তাঁরা ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিল। এর মাধ্যমেই তাঁরা পাকিস্তানিদের ভিত নাড়িয়ে দিতে অনেকাংশে সফল হয়। অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে পাকবাহিনীরা আতঙ্কিত হয়ে পরেছিল। মুক্তিযুদ্ধে অ্যাভলুজসহ মোট ৬টি সফল নৌ অপারেশন করেছেন এই আবুমুসা চৌধুরী। অ্যাভলুজ ছিলো তাঁর ৩য় অপারেশন। ১ম অপারেশন ছিল ১৪আগস্টের অপারেশন জ্যাকপট ও ২য় অপারেশন ছিল আউটার অ্যাঙ্কর। পরবাশে থাকার ব্যাপারে স্মৃতিচারন করতে গিয়ে তিনি তাঁর অ্যাভলুজ অপাশেনের সূত্র ধরে জানান, “৭১’র ২রা অক্টোবর নৌ-কমান্ডো হিসেবে আমার উপর দায়িত্ব পরে গ্রিসের পতাকাবাহী তেলের জাহাজ অ্যাভলুজ ধ্বংসের। রাত ১২টায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় গুপ্তখালের দুই মাল উজান থেকে শুরু হয় আমার অভিযান। কোমরে বেঁধে নিই দুটি মাইন লিমপেট। পেটের সাথে গামছা বেঁধে পেছিয়ে নিই আরো দুটি মাইন। আরেকটি গামছায় পলিথিনের পুটলিতে লুঙ্গি, জামা, ৩০০টাকা, আনুষাঙ্গিক কিছু জিনিস। তখন কর্ণফুলী শাখা খালটিতে জোয়ার। তার উপর খালের ঝোঁপে কাটার আঘাত। আঘাতে আঘাতে শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝরছিল। তবুও এগুতে লাগলাম সামনের দিকে। পথে পথে রাজাকার ও পাক আর্মিদের দৃষ্টি ও বিভিন্ন বাঁধা অতিক্রম করতে হয়। অবশেষে রাত দুইটায় পৌঁছে যায় সেখানে।” “অ্যাভলুজ ধ্বংসের সময় অনেক ঝুঁকি নিয়েই জাহাজটির ইঞ্জিন বরাবর দুটির মতো লিমপেট লাইন লাগিয়ে দিয়। এসব লিমপেট ৪৫মিনিট পর বিষ্ফোরণ করার নিয়ম থাকলেও আমি নির্ধারিত দূরত্ব অতিক্রম করারআগেই ১০মিনিটের মাথায় প্রথম লিমপেট মাইনও বিষ্ফোরণ ঘটে। বিষ্ফোরণের শব্দে আমি কেঁপে উঠি। তাও লক্ষ্য চ্যুত হয়নি। ১ম মাইনের বিষ্ফোর ণহওয়ার সাথে সাথে ১৭হাজার মেট্রিকটনের ওজনের জাহাজ শুণ্যে উঠানামা করে। তখন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। বিকট শব্দের তোড়েনাক ও কানদিয়ে রক্ত ঝড়ছিল। প্রায় ৩০মিনিট পর কর্ণফুলী নদীর পাড়ে পৌঁছাতেই মাইনের বিষ্ফোরণের ফলে ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয় জাহাজটি।” “এই জাহাজটি ধ্বংসের সময় আমার মাথায় ক্ষরণ যুদ্ধের ২দশক পর কঠিন ব্যাধিতে রূপ নেই। দেশের চিকিৎসা সেরে না উঠার ১৯৯৫সাল থেকে ক্রমান্বয়ে আমেরিকা থেকে চিকিৎসা নিই। বেঁচে থাকলেও ৭১’র ক্ষত আমাকে এখনো তাড়িয়ে চলেছে।” যুদ্ধকালীন তিনি ছিলেন এসএসসি পরিক্ষার্থী। পড়তেন ফটিকছড়ি উপজেলার নারায়ণহাট ইউনিয়নের তৎকালীন নারায়ণহাট বাজার হাই স্কুলে (বর্তমান নারায়ণহাট কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয়)। দায়িত্ব পালন করেন ছাত্রলীগের উত্তর ফটিকছড়ি ও স্কুল কমিটির সভাপতির। বাবা সুলতান আহমেদ চৌধুরী ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী। আবু মুসা চৌধুরী এর অপারেশন গুলো ছিল নিঃসন্দেহে আত্মত্যাগী অভিযান। নানা প্রাণ ঝুঁকি নিয়ে এসব অপারেশনে অংশ নেন তিনি। অসীম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন আবু মুসা চৌধুরী সহ অন্যান্যরা। সময়ের এই সাহসী সন্তানদের ঋণ শোধ হবার নয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

আওয়ামী লীগ বিএনপিকে রাজনীতি থেকে সরানোর চেষ্টা করেছে আজ তারা হারিয়ে গেছে- ড্যানী

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয় নেত্রকোনা : যারা বিএনপিকে রাজনীতি থেকে সরানো করার চেষ্টা করেছে তারাই হারিয়ে গেছে। বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা নিজের জীবন বাজি রেখে রাজনীতি করেছে, নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাদেরকে কিন্তু মানুষ এখনো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। বুধবার(১৯ মার্চ) সন্ধ্যায় নেত্রকোনা জেলা শহরের পুরাতন কালেক্টরেট মাঠে আয়োজিত দোয়া ও ইফতার মাহফিলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ […]

মশা কাদের বেশি কামড়ায়?

Share the post

Share the postগরমের দিনগুলোতে মশার উপদ্রব বেড়ে যায় আর সেই সঙ্গে বাড়ে মশার কামড়ের যন্ত্রণা। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, মশা সবাইকে সমানভাবে কামড়ায় না কেন? গবেষণায় দেখা গেছে, মশা বিশেষ কিছু রক্তের গ্রুপের প্রতি বেশি আকৃষ্ট। একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে, ‘O’ গ্রুপের রক্তধারীরা মশার বিশেষ শিকার। জাপানের একটি গবেষণা অনুসারে, O গ্রুপের রক্তধারীদের মশার কামড়ের […]