আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ

Share the post

আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১৮ মিনিটের এক জাদুকরি ভাষণে বাঙালি জাতিকে স্বপ্নে বিভোর করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, ৯ মাসের লড়াই এবং স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে আর থাকা যাবে না—এ ধারণা বাঙালির মনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছিল ৭ মার্চের আগেই। ফলে স্বাধীনতাতেই সমাধান দেখছিল আপামর জনতা। প্রশ্ন ছিল, কীভাবে সেই স্বাধীনতা অর্জিত হবে? ৭ মার্চ বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো স্বাধীনতাসংগ্রামের রূপরেখা দেন। এ ভাষণে জাতিকে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বানের পাশাপাশি ছিল দিকনির্দেশনাও।

সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এদিন লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’

করোনা সংক্রমণের কারণে এক বছর ধরে সব ধরনের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কর্মসূচি কাটছাঁট করা হয়েছে। ৭ মার্চের কর্মসূচিতেও তাই গণজমায়েত থাকছে না। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ দিবসটি উদ্‌যাপন করবে। আওয়ামী লীগ দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করবে।

বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ বাঙালি জাতির কাছে সব সময়ই বিশেষ কিছু। ২০১৭ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো বিশ্ব ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করে ভাষণটিকে। সংস্থাটি বিশ্বের ৭৮টি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল, নথি ও বক্তৃতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও অন্তর্ভুক্ত করে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনকের ঐতিহাসিক ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করতে দেয়নি তখনকার পাকিস্তান সরকার। কিন্তু পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় তা ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসেন বেলা ৩টা ২০ মিনিটে। মঞ্চে উঠেই তিনি জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লাখ লাখ বাঙালির কণ্ঠে ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ ধ্বনিত হয়। বঙ্গবন্ধু দরাজ গলায় তাঁর ভাষণ শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি…।’

১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু সামরিক শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। জবাবে ক্ষুব্ধ বাঙালি রাজপথে নেমে আসে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয়, তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দেন। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি নতুন প্রেরণা খুঁজে পায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। বিশ্বমানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর বাণীতে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর কালজয়ী ভাষণগুলোর অন্যতম। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তিকামী জনগণকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে ওই ভাষণ ছিল এক মহামন্ত্র।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেন, বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অমিত শক্তির উৎস ছিল এই ঐতিহাসিক ভাষণ।

‘গণ সূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার অমর কবিতা শুনিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ এর ৭ মার্চের বিকেলের অপ্রতিরোধ্য বজ্রকণ্ঠ, দ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে। ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ঢাকার রেসকোর্স মাঠে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণের অনবদ্য চিত্র তুলে ধরেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হল’ কবিতায়। কবি লিখেছেন , ‘সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’

বঙ্গবন্ধুর সেই অমর ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর ইউনেসকো ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বড় বিষয় হলো, যুদ্ধ ও সামাজিক বিপর্যয় এবং সংরক্ষণের অভাবে বিশ্বজুড়ে ঝুঁকিতে থাকা নথিগুলোকে ২০ বছর ধরে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে ইউনেসকো। এ পর্যন্ত এসব স্বীকৃতির মধ্যে ইউনেসকো প্রথম কোনো ভাষণকে স্বীকৃতি দেয়, যা ছিল অলিখিত।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেসকোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির অধীনে আন্তর্জাতিক তালিকায় (ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার) মোট ৭৮টি দলিলকে মনোনয়ন দেয়। এ তালিকায় ৪৮ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিকে স্থান দেয়া হয়।

বিশ্ব ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আন্তর্জাতিক তালিকাই মূলত মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের ঘটনার সংরক্ষণ ও সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে ইউনেসকো। এই তালিকায় ঠাঁই পেতে হলে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক প্রভাব থাকতে হয়।

১৯৯২ সালে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রাম চালু করে ইউনেসকো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দালিলিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও ব্যবহারে সচেতনতার তাগিদে এটি চালু হয়। যুদ্ধ ও সামাজিক অস্থিরতা, সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে দালিলিক ঐতিহ্য নিয়ে সমস্যা বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন সংগ্রহশালা বিনষ্ট হয়েছে। লুটপাট, অবৈধ বিক্রি, ধ্বংস, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও তহবিলের উদ্যোগে নষ্ট হয়েছে দলিল। অনেক দলিল নষ্টের ঝুঁকিতে।

ইউনেসকোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড তালিকায় থাকে ঐতিহ্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মারক নিদর্শন। এই তালিকায় ঠাঁই পেতে হলে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক প্রভাব থাকতে হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে নতুন করে প্রস্তাবিত ঐতিহাসিক দলিল দুই বছর ধরে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করে দলিলগুলো নির্বাচন করা হয়।

২০২০ সালের গত ৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ পাঠ্যপুস্তকে নিয়ে আসা উচিত। এখনকার প্রজন্মকে এই ভাষণ শোনানো উচিত। ঐতিহাসিক এই ভাষণের আধেয় জানানো উচিত। সাতই মার্চকে ‘জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস’ ঘোষণা চেয়ে করা এক রিটের শুনানিতে আদালত এই অভিমত দেন।

৭ মার্চকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করে গেজেট জারির নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ২০২০ সালের গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ড. বশির আহমেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।

এর আগে, ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর এক রিটের শুনানি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণের স্থানে মঞ্চ পুনর্নির্মাণ করে সেখানে তার ভাস্কর্য এবং ৭ মার্চকে ঐতিহাসিক জাতীয় দিবস হিসেবে কেন ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬৮০ কোটি টাকার প্রকল্প শুরুর আগেই, ল্যাপটপ ফটোকপি মেশিন ক্রয়ের নামে ২৫ লাখ টাকা উঠিয়ে নেয়ার অভিযোগ

Share the post

Share the postমো. নাঈম হাসান ঈমন, ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এবং সাবেক এমপি আমির হোসেন আমুর পছন্দের লোক হওয়ায় ২০২৩ সালে মার্চ মাসে ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পান এ.কে.এম নিলয় পাশা। গত বিশ মাসে নানা কৌশলে ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অফিস চত্বরের কয়েক […]

ঝালকাঠিতে জমে উঠেছে ‘হাউন আঙ্কেলের ভাতের হোটেল’

Share the post

Share the postমো. নাঈম হাসান ঈমন, ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ কোন সিনেমার গল্প কিংবা ট্রল নয়, এবার সত্যিই চালু হয়েছে হাউন আঙ্কেলের ভাতের হোটেল। ভাইরাল এই নামটি শুনেই দিন দিন বাড়ছে গ্রাহকের সংখ্যা। লাভও হচ্ছে বেশ ভালই। আর হাউন আঙ্কেলের ভাতের হোটেলটির গ্রাহকরাও খাবারের মানে দারুণ সন্তুষ্ট। বর্তমানে পলাতক থাকা সাবেক ডিবি পুলিশ প্রধান হারুণ অর-রশীদ তার […]