কাঠের কয়েনের মোহে পিএইচপির কর্ণধার উড়িয়ে দিলেন ২ কোটি টাকা, আনন্দ গ্রুপ দেড় কোটি

Share the post

কাঠের একটি কয়েন কিনতে এক প্রতারকের পেছনে ২ কোটি টাকা ঢেলেছে চট্টগ্রামভিত্তিক পিএইচপি গ্রুপের এক কর্ণধার। ওই কয়েনটি কিনতে তিনি এতোটাই ‘পাগল’ হয়ে গিয়েছিলেন যে, প্রতারককে আরও টাকা দেওয়ার জন্য তৈরি ছিলেন তিনি। নামি ওই শিল্পপতির কাণ্ডকারখানা জানার পর তার পরিবারের এক সদস্য শরণাপন্ন হন পুলিশের। পরে পুলিশ পিএইচপি গ্রুপের ওই ব্যবসায়ীকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে প্রতারকদের খপ্পর থেকে রক্ষা করে।

বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) রাজধানীর ধানমণ্ডির পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের এক বড় ব্যবসায়ী (পিএইচপি গ্রুপ) এই কয়েনের প্রলোভনে ২ কোটি টাকা দিয়েছেন। আরও টাকা দিবেন বুঝতে পেরে তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে আটকে রাখেন তার জামাতা। তার জামাতাও চট্টগ্রামের বড় ব্যবসায়ী। কোনভাবে তার শ্বশুরকে আরও টাকা দিতে আটকাতে না পেরে আমাদেরকে জানান। পরে আমরা বিমানবন্দর থেকে আমাদের গাড়িতে করে ওই ব্যবসায়ীকে অফিসে নিয়ে আসি। তিনি প্রতারকদের টাকা দিতে এমন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন যে বাসায় যেতে পারলে আবার টাকা দেবেন।’

পিএইচপি গ্রুপের শিল্পপতিই শুধু নয়, কাঠের ওই কয়েনটি ঘিরে মিলিয়ন ডলার লাভের আশায় কোটি কোটি টাকা খুইয়েছেন একাধিক নামি ব্যবসায়ী, প্রথম শ্রেণির অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাও।

পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘এই কাঠের কয়েনের কী এক তেলেসমাতি! যেন টাকা না দিতে পারলে তাদের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যেন ইচ্ছে করে সবাই প্রতারিত হওয়ার জন্যই টাকা দিচ্ছেন।’

সম্প্রতি এই কয়েনের ঘোরে সরকারের প্রথম শ্রেণীর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার পেনশনের ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা তুলে দিয়েছেন প্রতারকদের হাতে। আরেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খুইয়েছেন ৮৪ লাখ টাকা। চট্টগ্রামভিত্তিক পিএইচপি গ্রুপের এক কর্ণধার ২ কোটি টাকা দেওয়ার পর আরও টাকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন।

গত ডিসেম্বরে আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান এই প্রতারকদের হাতে নগদ দেড় কোটি টাকা তুলে দেন। আরও টাকা দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে প্রতারণার বিষয়টি ধারণা করেন তিনি। পরে এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।

ওই মামলার তদন্তে গিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কয়েন ঘিরে মহাপ্রতারণার তথ্য উদঘাটন করে। এরপর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তার পাঁচজন হলেন আক্তারুজ্জামান, সালাম, মনিরুজ্জামান কামরুল ওরফে জামান, আবু তাহের জবা ও শফিকুল ইসলাম স্বপন। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত দুটি কাঠের কয়েন, নগদ ২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ও বিভিন্ন উপকরণ জব্দ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার

জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহেল বারীর প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে পিবিআই জানায়, আবু তাহের জবা নিজেকে বড় ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিতেন। তার দেশে বিদেশে অনেক ব্যবসা ছাড়াও স্পেন-দুবাইতে নিয়মিত যাতায়াত বলে জানান। আদতে এসএসসি পাশ জবা আগে নিজ বাড়িতে পেয়ারা চাষ করতেন। প্রায় এক বছর আগে জবার সঙ্গে আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারীর পরিচয়।

বিশ্বাস স্থাপনের এক পর্যায়ে প্রতারক জামান বলেন, দেশের সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা সালাম নামে একজনের কাছে একটি কয়েন আছে। কয়েনটি নাসায় গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়। জামান নামে একজন আমেরিকান ক্রেতাও আছে যিনি কয়েনটি কিনবেন। কিন্তু মূল্যবান এই কয়েন কেনাবেচায় মিলিয়ন ডলারের লেনদেন। তাই তিনি আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যানের অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার করতে চান। এজন্য তিনি একটা মোটা অঙ্কের টাকা কমিশন পাবেন। এর মধ্যে ক্রেতা মনিরুজ্জামান কামরুল ওরফে জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন জবা।

জামানের সঙ্গে নাসা, সিআইএ কিংবা ইউএস অ্যাম্বাসির যোগাযোগ রয়েছে বলে জানান জবা। আসলে জামান একজন শাড়ি ব্যবসায়ী। স্বপন জামানের পিএ হিসেবে পরিচয় দিতেন। জামান ওই অমূল্য কয়েনটি কিনবেন আর লেনদেনে ব্যবহার করবেন আনন্দ গ্রুপের অ্যাকাউন্ট। প্রতারক আক্তারুজ্জামান সীমান্ত এলাকায় থাকেন, তিনি বিক্রেতা খোঁজেন। আসলে তিনি এইচএসসি পাশ আর ঝিনাইদহের একটা বাড়িতে কেয়ার টেকারের চাকরি করেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৯ ডিসেম্বর আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যানকে চুয়াডাঙ্গায় নিয়ে ‘অমূল্য’ ওই কয়েন দেখান। তার সামনেই বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে কয়েনটি পরীক্ষা করে দেখানো হয়। একপর্যায়ে কয়েনের পাসওয়ার্ড নিতে ভারতে ফোন দেওয়া হয়।

পরে হিন্দিতে কথা বলে পাসওয়ার্ড নেওয়া হয়। এককথায় বিশ্বাস স্থাপনের জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করতে থাকে প্রতারকরা। একপর্যায়ে কয়েনের দাম ঠিক হয় ১০ কোটি টাকা। এ সময় ক্রেতা জামান তাৎক্ষণিক সাড়ে আট কোটি টাকার ‘চেক’ দেয়। প্রলোভনে পড়ে নগদ বাকি দেড় কোটি টাকা দিয়ে দেয় আনন্দ গ্রুপ। কিছুদিন পর ব্যাপারটি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হলে আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান আইনের আশ্রয় নেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি তদন্তে ইবিতে তথ্য চেয়ে নোটিশ

Share the post

Share the postসুবংকর রায়, ইবি প্রতিনিধি :কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি)২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ-সংক্রান্ত অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতাকারীদের চিহ্নিতকরণে তথ্য চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। আর এসকল সংক্রান্ত তথ্য অনুসন্ধানের নিমিত্তে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। আজ মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ-সংক্রান্ত অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতাকারীদের […]

নরসিংদীতে পোশাককর্মীর পর এবার ৩ সন্তানের জননীকে ধর্ষণের অভিযোগ

Share the post

Share the post আশিকুর রহমান, নরসিংদী :- নরসিংদীর বেলাবতে এক পোশাককর্মীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগের পর এবার রায়পুরা উপজেলায় ৩ সন্তানের জননী পঞ্চাশোর্ধ এক নারী ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। পরপর এধরণের ঘটনায় জেলাজুড়ে আতংক ছড়িয়ে পড়ছে। তবে বেলাব এর ঘটনায় পুলিশ ২ জনকে আটক করেছেন। আটককৃতরা হলেন, বেলাব উপজেলার মাটিয়াল পাড়া গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে দেলোয়ার হোসেন […]