নেত্রকোনায় পর্যটক শূণ্য বিজয়পুর সাদামাটির পাহাড় পর্যটন কেন্দ্র

Share the post
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা: পর্যটক শূণ্য হয়ে পড়েছে নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলার সাদামাটির পাহাড় খ্যাত বিজয়পুর পর্যটন কেন্দ্র। ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশান প্রোডাক্ট বা জিআই পণ্য) হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া এই পণ্যকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে পর্যটন কেন্দ্র। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটকরা ছুটে আসলেও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অব্যবস্থাপনার কারণে পর্যটকদের পড়তে হয় নানা ভোগান্তিতে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে সোমেশ্বরী নদী পারাপার, রানী রাশমনি স্মৃতি সৌধ হতে সাদামাটির পাহাড় পর্যন্ত রাস্তার বেহাল অবস্থা এবং পর্যটন এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবকেই পর্যটক শূণ্য হওয়ার কারণ হিসাবে মনে করছেন স্থানীয়রা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপরুপ লীলাভুমি ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলা। দুই সীমানায় পাহাড়, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে সোমেশ্বরী নদী। দৃশ্যটি দেখে মনে হয়, পাষাণ পাহাড়ের বুক চিরে সোমেশ্বরী নিরবে বয়ে চলছে বাংলার বুকে। সোমেশ্বরীর জলে ভেসে আসা বালু, নুড়ি পাথর আর কয়লা উত্তোলন ও পরিবহন যেন এক উৎসব। বালু, পাথর উত্তোলনে ব্যবহৃত ড্রেজার মেশিনের বিকট শব্দ শ্রমিকদের কাছে যেন বাদ্যের তাল। বালু পরিবহণে ব্যবহৃত শত-শত গাড়ির বহর সৌন্দর্যের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই অঞ্চলের সৌন্দর্য্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ চিনামাটির পাহাড় যা সাদামাটির পাহাড় নামেই অধিক পরিচিত। সুসং দুর্গাপুর হতে মাত্র সাত কিলোমিটার দুরে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের আড়াপাড়া ও মাইজপাড়া মৌজায় বিজয়পুরের শসারপাড় ও বহেড়াতলী গ্রামে অবস্থিত চিনামাটির পাহাড়। এই মাটি সিরামিক শিল্পের প্রধান কাঁচামাল। ১৯৫৮ সালে খনিজ সম্পদ বিভাগ এই সাদামাটির পাহাড়ের সন্ধান পায়। ছোট-বড় টিলা ও সমতল ভূমি মিলিয়ে ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৬৬ মিটার প্রস্থে খনিজ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হয়। ১৯৬০ সালে কোহিনূর অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চিনা মাটি উত্তোলন কাজ শুরু করে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) ভৌগলিক পণ্য ইউনিট আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস্ অরগানাইজেশনের নিয়ম মেনে বিজয়পুরের সাদা মাটি ২০২১ সালে ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশান প্রোডাক্ট বা জিআই পণ্য) হিসাবে স্বীকৃতি পায়। এই সাদামাটি সারাবিশ্বে বাংলাদেশের একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের পণ্য হিসাবে পরিচিতি পায়। জিআই পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ায় পণ্যটি বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয় এবং এই পণ্যের বিশেষ কদর থাকে। জিআই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত পণ্য ওই দেশ বা অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের আইনী অধিকার রাখে।
জানা যায়, বিজয়পুরের সাদামাটি অত্যন্ত মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য একটি খনিজ সম্পদ। সাধারণত সিরামিকের তৈজসপত্র, টাইলস, স্যানিটারি ওয়্যার ও গ্লাস তৈরির ক্ষেত্রে এই মাটি ব্যবহৃত হয়। উৎকৃষ্টমানের এ মাটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট হচ্ছে, এটি প্রাকৃতিকভাবেই কেওলিন বা এ্যালুমিনিয়াম সমৃদ্ধ। অনেকে এটিকে চিনামাটিও (চায়না ক্লে) বলে থাকেন। এখানকার পাহাড়ী টিলা কেটে অনেক গভীর স্তর থেকে সাদামাটি তোলা হতো। সাদামাটির পাশাপশি সেখানে কালো, খয়েরি, বেগুনি ও নীল সহ বিভিন্ন রঙের মাটির স্তর রয়েছে। বর্তমানে খনন কাজ বন্ধ থাকলেও খনন করা এলাকাগুলোতে নানা রঙের মাটির স্তর সুস্পষ্ট দেখা যায়, যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। খনন করে মাটি উত্তোলনের ফলে পরিণত হয়েছে নীল পানির লেক। লেকটি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সুদৃশ্য। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। বিজয়পুরের সাদামাটি প্রকল্প এলাকাটি এখন পরিণত হয়েছে পর্যটন শিল্পে। প্রতিদিন হাজারো পর্যটকদের আনাগোনায় মুখোরিত হতো সাদামাটির পাহাড়খ্যাত বিজয়পুর। এখানে গড়ে উঠেছে খাবার হোটেল ও ভারতীয় বাহারী পণ্যের বাজার। স্থানীয় ব্যবসায়ী মিরাস উদ্দিন বলেন, সাদামাটির পাহাড়কে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশতাধিক দোকান। দোকানগুলোতে ভারতীয় চকলেট, তেল, সাবান সহ বিভিন্ন প্রসাধনি সামগ্রী বিক্রি হয়। গত মাসে বিটিভিতে প্রচারের জন্য ইত্যাদি অনুষ্ঠানের সুটিং থাকায় দর্শক এসেছিল। তারপর থেকে তেমন পর্যটক আসেনা। সারাদিন কোন বিক্রি না হওয়ায় অধিকাংশ দোকান এখন বন্ধ থাকে। শসারপাড় গ্রামের বাসিন্দা মনসুর আলী বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পর্যটকগণ সোমেশ্বরী নদীতে ঝুঁকি নিয়ে পারাপারের ভয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। রানী রাশমনি স্মৃতি সৌধ হতে সাদামাটির পাহাড় পর্যন্ত রাস্তার বেহাল অবস্থা এবং ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটকরা হতাশা প্রকাশ করেন।নেত্রকোণা সরকারি মহিলা কলেজের অবসর প্রাপ্ত অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলাম জানান, বিজয়পুরের সাদামাটি অত্যন্ত মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য একটি খনিজ সম্পদ। এই মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য একটি খনিজ সম্পদকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে এই পর্যটন কেন্দ্র এখন পর্যটক শূণ্য। বিশেষ করে সোমেশ্বরী নদীতে একটি ব্রীজ নির্মাণ হলে সহজেই পর্যটকরা বিজয়পুরের পর্যটন কেন্দ্রে আসতে পারতো। তাছাড়াও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার হতে রানীখং পাহাড়ের পাশ দিয়ে রাস্তাটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই পথে নিয়োমিত ভারতীয় কয়লা, পাথর সহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী আনা নেওয়া হতো।
এই স্থল বন্দরটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় সীমান্তে বেড়েছে অবৈধ চোরাকারবারীর দৌরাত্ম। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব। সীমান্তে চোরাচালান বন্ধে এবং সীমান্ত সুরক্ষার বিষয় বিবেচনায় এনে সরকার বর্ডার রোড তৈরি করেছেন। সোমেশ্বরী নদীতে সেতুর অভাবে এই বর্ডার রোডে সংযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন। সোমেশ্বরী নদীর উপর একটি সেতুই পারে বিজয়পুর পর্যটন কেন্দ্র, বিজয়পুর স্থল বন্দর এবং বর্ডার রোডের সেতুবন্ধন তৈরি করতে। দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম রকিবুল হাসান বলেন, বিজয়পুরের সাদামাটি অত্যন্ত মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য একটি খনিজ সম্পদ। দুষ্প্রাপ্য এই খনিজ সম্পদ দেখার জন্য সারাদেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক এখানে আসে। এই সাদামাটির পাহাড়কে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। কুল্লাগড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় হতে বিপিনগঞ্জ বাজার পর্যন্ত রাস্তা সরু হওয়ায় পর্যটকদের যাতায়াত খুব কষ্টকর হয়। রাস্তাটি প্রশস্ত ও সোমেশ^রী নদীতে ব্রীজ নির্মাণ হলে পর্যটকদের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় (এলজিইডি) নেত্রকোণা কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী মোঃ রবিউল ইসলাম জানান, কুল্লাগড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় হতে বিপিনগঞ্জ বাজার পর্যন্ত রাস্তার ভাঙ্গা অংশ সংস্কার কাজের টেন্ডার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দ্রুত সংস্কার করা হবে বলে তিনি জানান।নেত্রকোণা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আলনূর সালেহীন জানান, সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান কার্যালয় থেকে দুর্গাপুর সোমেশ্বরী নদীতে দ্বিতীয় সোমেশ্বরী ব্রীজ নির্মাণের সমীক্ষা কার্যক্রম চলমান।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

নেত্রকোনায় আওয়ামী নেতা কর্মীরা জামিন না পাওয়ায় আদালত চত্বরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : বিশেষ সূত্রে জানা যায় গত (২৪ ডিসেম্বর) মঙ্গলবার নেত্রকোনায় আদালতে আত্মসমর্পণ করতে গিয়ে জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় আদালতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছেন আসামিরা। এসময় হট্টগোল সৃষ্টি হয়। এই ঘটনার সময় আসামিদের পাশে থাকা এক যুবককে মারধর করার অভিযোগও ওঠেছে। গত মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) দুপুর দেড়টার দিকে এমনই ঘটনা ঘটেছে […]

নেত্রকোনায় বোরো আবাদে ব্যস্ত হাওরাঞ্চলের কৃষক, দেখা দিয়েছে শ্রমিক সংকট

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : নেত্রকোনার ১০ উপজেলার মধ্যে তিনটি হাওরাঞ্চল। এই তিন উপজেলা হলো মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী ও মদন। এ তিনটিতে বর্তমানে পুরোদমে চলছে বছরের প্রধান ফসল বোরো ধানের আবাদ। প্রতিদিনই তীব্র শীত উপেক্ষা করে বোরো আবাদে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক। তবে শ্রমিক সংকটের কারণে বোরো আবাদ করতে […]