

সোহেল খান দূর্জয়,নেত্রকোনা প্রতিনিধি : সভ্যতার ক্রমবিকাশ আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় নেত্রকোনার গ্রামগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ খেলাধুলা। ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাধুলা নির্মল আনন্দের জীবন্ত উৎস, বিনোদনের খোরাক। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই আজ বিলুপ্তির পথে। তারপরও গ্রামীণ জনপদে এখনও কিছু খেলাধুলা চোখে পড়লেও উৎসাহ-উদ্দীপনা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাও প্রায় বন্ধ হতে চলেছে।
একসময় গ্রামীণ সমাজের শিশুরা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন খেলাধুলার মাধ্যমে অবসর সময় কাটাত। বিকাল হলেই খোলা মাঠে দল বেঁধে খেলতে যেত। শিশু মানেই দৌড়ঝাঁপ, কোলাহল আর দুরন্তপনা। দুরন্তপনা ছাড়া যেন শৈশব কল্পনাই করা যায় না। অথচ প্রযুক্তির এ যুগে শিশুদের মধ্যে, বিশেষ করে শহরের শিশুদের মধ্যে দুরন্তপনা যেন আর নেই বললেই চলে। ঘরে বসে কম্পিউটার, মোবাইলে গেমস খেলতেই তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
গ্রামীণ খেলাধুলা আমাদের প্রাচীন ক্রীড়া সংস্কৃতি। একসময় গ্রামীণ খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করত। বর্তমানে গ্রামীণ খেলা বিলুপ্ত হতে হতে আজ তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই কঠিন। দেশের বিভিন্ন এলাকার গ্রামাঞ্চলে একসময় প্রায় শতাধিক গ্রামীণ খেলাধুলার প্রচলন ছিল। তার মধ্যে ছেলেরা খেলত হা-ডু-ডু, ডাংগুলি, কাবাডি, সাতগুটি, ষোলগুটি, লাটিম ঘোরানো, ঘুড়ি উড়ানো, দড়ি লাফ, গাদন, মার্বেল, কপালটোকা, কানামাছি, মালাম খেলা, কুস্তি, ডুব সাঁতার, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, হৈল বৈল, বস্তাদৌড়, ফুটবল, লুকোচুরিসহ এমনি আরও অনেক খেলা। আর মেয়েরা খেলত গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, এক্কাদোক্কা, চোর-পুলিশ, বৌছি, কুতকুত, কড়িখেলা, বালিশ বদল, ইচিং বিচিং, লুকোচুরি, পুতুল খেলা, ওপেন্টি বায়োস্কোপ, এলাটিং বেলাটিং, চেয়ার খেলা, লুডু, রান্নাবাটিসহ বিভিন্ন খেলা। খেলাগুলোর মধ্যে এখনও হা-ডু-ডু, কাবাডি, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলাসহ হাতেগোনা কয়েকটির প্রচলন আছে। গ্রামাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ, মহরম ও গ্রামীণ উৎসবে এখনও এসব খেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার পরিবর্তে অনেকদিন আগেই এদেশে প্রচলন হয় ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার। ক্রিকেট খেলা আমাদের দেশীয় খেলা না হলেও বর্তমানে তা আমাদের দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
একসময় রাখাল ছেলেরা মাঠে গরু চরাতে গিয়ে ডাংগুলি খেলত। স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা স্কুলের টিফিন সময়ে নানা ধরনের গ্রামীণ খেলা নিয়ে মেতে থাকত। বর্তমানে শহরাঞ্চলে তো বটেই, গ্রামাঞ্চলেও খোলা জায়গা বা খেলার মাঠের স্বল্পতার কারণে এসব খেলা আর তেমন চোখে পড়ে না। বর্তমানে ভিডিও গেমস, টেলিভিশন, মোবাইলফোন ইত্যাদি গ্রামীণ খেলাধুলার সে স্থান দখল করে নিয়েছে। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার ফাঁক পেলেই টিভিতে কার্টুন দেখে, মোবাইলে গেমস খেলে। পড়াশোনা যেমন ছেলেমেয়েদের মানসিক বিকাশ ঘটায়, তেমনি শারীরিক বিকাশ ঘটাতে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই।
আগেরকার দিনে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ দিবসে হা-ডু-ডু, কাবাডি ও লাঠিখেলার জন্য প্রতিযোগিতা হতো। বিভিন্ন গ্রামে এসব খেলার জমজমাট আয়োজন হতো। এসব খেলা দেখার জন্য অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দলে দলে এসে উপস্থিত হতো খেলার মাঠে। খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণ করা হতো। ভালো খেলোয়াড়দের সমাজের সবাই অনেক সম্মান করত। আবার প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষার পর বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে স্কুল, কলেজ, মাদরাসাগুলোয় নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হতো। ভালো খেলোয়াড়দের শিক্ষকরা পুরস্কার দিতেন। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে খেলাধুলার উৎসাহ বাড়ত। বর্তমানে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো খেলার মাঠ নেই, তাই মাঠে গিয়ে খেলার প্রতি শিশুদের আগ্রহ কম। তাছাড়া কায়িক পরিশ্রমের খেলাধুলা না করার ফলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশও ঘটছে না। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তি যেমন ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাকে কেড়ে নিয়েছে, তেমনি এ প্রজন্মকে ক্রমেই ঠেলে দিচ্ছে মাদকের দিকে। ফলে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ মেধাশূন্য হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই মাদকের ভয়াল গ্রাস থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে, গ্রামীণ খেলাকে বাঁচাতে এদেশের সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে।
খেলার মাঠের স্বল্পতা, স্মার্টফোনে ভিডিও গেমসের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির কারণেই গ্রামীণ খেলাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে ক্রীড়া সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। গ্রামীণ খেলাধুলা সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে এমন শহুরে শিশু-কিশোরদের খোঁজ মেলা মুশকিল। গ্রামীণ খেলাধুলার গল্প শহুরে শিশুদের কাছে রূপকথার গল্পের মতো।
আমাদের আদি ক্রীড়া সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে গ্রামীণ ক্রীড়া ফেডারেশন গঠন করা দরকার। এতে আগামী প্রজন্ম আমাদের এসব খেলাকে জানতে পারবে। ভুলে যাবে না নিজস্ব ক্রীড়া ঐতিহ্য। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট একসময় বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল। তখন ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এগিয়ে আসেন ক্রিকেটকে বাঁচাতে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত হয় মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)। এ ক্লাবটি ক্রিকেটকে সংকটময় অবস্থা থেকে রক্ষা করেছে। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে যে কোনো খেলা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে।
ক্রীড়াঙ্গন উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে ৪৯০টি মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় এসব মিনি স্টেডিয়ামগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উপজেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে খেলাধুলার যাতে বিকাশ ঘটে এবং খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টি হয়, সে লক্ষ্য নিয়েই সরকার উপজেলা পর্যায়ে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ ও সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে নতুন খেলোয়াড় সৃষ্টি হবে, খেলার মানোন্নয়ন ঘটবে, বিশ্বে বাংলাদেশ খেলাধুলায় অন্যতম সেরা দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে এবং অনেক লোকের কর্মসংস্থানও হবে।
শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মানস গঠনে শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতি চর্চার কোনো বিকল্প নেই। খেলাধুলা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি অনুধাবন করে প্রতি বছর বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে। বছরব্যাপী তৃণমূল পর্যায় থেকে বালক ও বালিকাদের বাছাই করে আয়োজন করা হয় এ টুর্নামেন্টের।
বর্তমান সরকার ক্রীড়াবান্ধব সরকার। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে লুকিয়ে থাকা প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের খুঁজে বের করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। তৃণমূল থেকে প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রম বর্তমান সরকারের নেওয়া সবচেয়ে আলোচিত পদক্ষেপ। ক্রীড়াঙ্গনকে সমৃদ্ধ এবং এদেশের ক্রীড়ার উন্নয়নের স্বার্থেই এ উদ্যোগ। এছাড়া বিলুপ্তপ্রায় দেশের ঐতিহ্যবাহী খোলাগুলো পুনরুদ্ধারেও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন নেত্রকোনার ক্রিয়াবীদরা। প্রধানমন্ত্রী হারিয়ে যাওয়া খেলাগুলো পুনরুদ্ধারে এবং তৃণমূল থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুঁজে বের করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন।
এ বিষয়ে নেত্রকোনার বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির পরিচালক কবি গীতিকার সুজন হাজং বলেন, সময়ের আবর্তে বিলীন হতে যাওয়া খেলাগুলোই আমাদের দেশের ঐতিহ্য। সেগুলোকে পুনরুদ্ধার করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও উদ্যোগ নেওয়া হলে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। এসব গ্রামীণ খেলাধুলার সঙ্গে রয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের নাড়ির সম্পর্ক, ঐতিহ্যের ধারা। এসব খেলায় তাদের স্মৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের উচিত গ্রামীণ খেলাধুলা বেশি করে আয়োজন করা। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর পরিচিতি ও তার সুফল সম্পর্কে আকৃষ্ট করা।