

সোহেল খান দূর্জয় ,নেত্রকোনা প্রতিনিধি : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং গত বছরের জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে নিশিতা বড়ুয়ার কণ্ঠে ‘রক্তমাখা সিঁড়ি’ নামে একটি ভিডিও গান প্রকাশ হয়েছে। গানটি লিখেছেন নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি ইউনিয়নে অবস্থিত ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমির পরিচালক সুজন হাজং। সুর ও সংগীত করেছেন সুমন কল্যাণ। মিউজিক ভিডিও পরিচালনা করেছেন সোহেল রানা বয়াতি।
গত ১৬ আগস্ট ‘সুজন হাজং অফিসিয়াল’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে গানটি প্রকাশ হয়। এতে মডেল হিসাবে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী তারিন জাহান। গানটি প্রকাশের পর থেকে বেশ প্রশংসিত হচ্ছেন সুজন হাজং ও নিশিতা বড়ুয়া। নিশিতা বড়ুয়ার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এটাই তার প্রথম গান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের একটি গানের জন্য মনে হচ্ছিল অনেকদিন অপেক্ষা করেছি। বঙ্গবন্ধু মহান নেতা, দেশের স্থপতি। তাকে নিয়ে গাইতে পেরে বেশ গর্ববোধ করছি। গানটি প্রকাশের পর থেকে অনেকেই প্রশংসা করছেন।’ এদিকে নতুন গান নিয়েও ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন এ সংগীতশিল্পী নিশিতা। গত ১৩ আগস্ট থেকে স্টেজ শোতেও ফিরেছেন তিনি। এরই মধ্যে চট্টগ্রামেও একটি শো’তে অংশ নিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর; শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, ময়মনসিংহ জেলার উত্তর অঞ্চল এবং সিলেট জেলায় হাজং সম্প্রদায়ের বসবাস। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসব অঞ্চলে খুব দাপটের সঙ্গে বসবাস করেছে এই সম্প্রদায়ের মানুষ। শুধু তাই নয়, ঐতিহাসিক হাজং বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, টঙ্ক আন্দোলনের নেতৃত্বে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন তারা।
হাজং সম্প্রদায়ের জীবন-সংগ্রাম নিয়ে নির্মিত হয়েছে বিশেষ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘হাজংদের জীবন সংগ্রাম’। সুজন হাজং-এর কবিতা অবলম্বনে এটি নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতি। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছে ৩১ জানুয়ারি হাজংমাতা ‘শহীদ রাশিমণি দিবসে’। এদিন চলচ্চিত্রটির বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছে। এ ছাড়া একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণের পর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
পরিচালক সোহেল রানা বয়াতি বলেন, ‘ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভারত ভাগ, মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে নিজেদের টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে হাজং জনগোষ্ঠীর সাহসী ভূমিকা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। গত দুই বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী হাজংদের জীবন খুব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করেছি।
গীতিকার সুজন হাজং বলেন ‘আমার লেখা ‘হাজংদের জীবন সংগ্রাম’ কবিতাটিতে বীরাঙ্গনা শহীদ হাজংমাতা রাশিমণির আত্মত্যাগ, নারীর সম্ভ্রম রক্ষা, হাজংদের সুদীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, তাদের বিলীয়মান সমৃদ্ধ সংস্কৃতির কথা, দুঃখ ও বঞ্চনার কথা তুলে ধরেছি। ডকুফিল্মটিতে প্রান্তিক হাজং সম্প্রদায়ের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, টঙ্ক আন্দোলন, জমিদার প্রথা উচ্ছেদ, হাতি খেদা আন্দোলন, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের বীরত্ব ও সাহসিকতার গল্প নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতি সুনিপুণভাবে চিত্রায়িত করেছেন।’
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি বিরিশিরি, নেত্রকোণার প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি। চিত্রগ্রহণ করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক কমল চন্দ্র দাস ও আশিক মাসুদ।
বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমির পরিচালক নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুরের কৃতি সন্তান গীতিকার সুজন হাজং।
তাকে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. অলিউর রহমান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপন সূত্রে এই তথ্য জানা যায়।
সুজন হাজং একাধারে কবি, গীতিকার, কলামিস্ট, গবেষক ও অনুবাদক ও তরুণ রাজনীতিবিদ। কবিতা ও গান লেখার পাশাপাশি তিনি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন।
নিয়োগের পর সুজন হাজং তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বৃহত্তর ময়মনসিংহে হাজং, গারো, কোচ, বানায়, হদি, ডালু ও বর্মণ নৃগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের নিজস্ব বর্ণিল সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে। পিছিয়ে পড়া এসব জনগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত।
তিনি বলেন, এটা আমার শেকড়। আমি এখানে বেড়ে উঠেছি। এখানকার মানুষের জীবনবোধ, জীবনাচার ও জীবন সংগ্রাম আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাই সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কাজ করতে আমি প্রতিশ্রুতিশীল।
সুজন হাজং আরও বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে বর্তমান সরকার নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। আমাকে বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির পরিচালক নিয়োগ প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
বিরিশিরি কালচারাল একাডেমি প্রসঙ্গে সুজন হাজং বলেন, একসময় ভালবাসা ও দ্রোহের কবি রফিক আজাদ বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির পরিচালক ছিলেন। প্রিয় কবি রফিক আজাদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বিরিশিরিতে। এখানকার সহজ সরল নৃগোষ্ঠীর জীবনধারার সাথে তিনি মিশে গিয়েছেন। তাদের নিয়ে লিখেছেন অগণিত কবিতা। আজ তিনি নেই। আমি হাজার কাজের ভিড়েও এখানে তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো খুঁজছি। এটাই হবে একজন অগ্রজ কবির প্রতি তার অনুজ কবির শ্রদ্ধা।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সার্কভুক্ত ছয়টি দেশের আটজন শিল্পী সুজন হাজংয়ের লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। পাশাপাশি নন্দিত সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী, নচিকেতা, শুভমিতা, ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, প্রিয়াংকা গোপ, অবন্তি সিঁথি, লুইপা, কিশোর, সাব্বির, মুহিন, লিজা, পুলক, রন্টি দাস, সুস্মিতা সাহাসহ নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাঁর লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।
সুজন হাজং মাতৃভাষা বিষয়ক একুশে পদকপ্রাপ্ত সংগঠন “দ্য মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটি, বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের জেনারেল সেক্রেটারি। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য।