ব্যাপক দুর্নীতির ও অনিয়মের আঁতুড় ঘর নেত্রকোনা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস

Share the post
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : নেত্রকোনা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ-দুর্নীতির যেন শেষ নেই। দুর্নীতি রোধে মাঝে মাঝে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা গেলেও কিছুদিন পরই দেখা যায় সবকিছু চলছে আগের মতোই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ একদিকে কড়াকড়ি করলে আরেকদিকে খুলে দেওয়া হয় দুর্নীতির নতুন পথ। অনুসন্ধানে নেত্রকোনা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গেলে সেবা গ্রহিতা ভুক্তভোগীরা অভিযোগ তোলেন  দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে পাসপোর্ট অফিস। এসব অফিসে অলিখিতভাবে দালাল নিয়োগ দিয়ে প্রকাশ্যে চলে ঘুষের কারবার। যখন একজন পাসপোর্ট সেবা গ্রহিতা কম্পিউটারের মাধ্যমে আবেদন করতে চাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই দোকান থেকে পাসপোর্টে ধরন ও ক্ষেত্রবিশেষ তিন হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। দালাল চক্র ও পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীদের সাথে বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকানদার সহ পাসপোর্ট অফিসের একাধিক ব্যক্তির যোগসাজশে পাসপোর্ট অফিসে কথিত ‘চ্যানেল মাস্টার’  ও নৈশ প্রহরীর মাধ্যমে এবং অ্যান্ড্রয়েমেন্ট এর দায়িত্বে যিনি আছেন হাসানের মাধ্যমে প্রতিদিন এই ঘুষের টাকা তোলা হয়। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, নেত্রকোনা পাসপোর্ট অফিসেই দিনে ঘুষ ওঠে কমপক্ষে কয়েক লাখ টাকা।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন (ছদ্মনাম) কম্পিউটারের দোকানদার বলেন, প্রতিদিন দুপুর ১২ টার পরে আর ফাইল জমা নেওয়া হয় না। যার কারনে অনেক ক্ষেত্রেই  দূর দূরান্ত থেকে আসা মানুষরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট অফিসে না পৌঁছালে পাসপোর্ট অফিসে সেবা প্রত্যাশীরা আর ফাইল জমা দিতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে চাকরিজীবী ব্যবসায়ীরাও ব্যস্ততার মাঝে  দুপুর ১২টার মধ্যে পাসপোর্ট অফিসে পৌঁছাতে পারেননা। এই ধরনের অনেক নিয়ম আছে। যার জন্য সেবা প্রত্যাশীরা ঝামেলায় এড়াতে আমাদের মতন কম্পিউটার দোকানে আবেদন করার পরে তারা হয়রানি শিকার হয়ে পুনরায় আমাদের কাছে ফিরে আসেন কিভাবে সহজে পাসপোর্ট করা। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসে বাস্তবতা ভিন্ন, টাকা দিলেই এখানে সবকিছু হয়। ওই অফিসে কে টাকা নেই এমন প্রশ্নের উত্তরের তিনি বলেন, অফিসে অনেকেই টাকা নিয়ে এ ধরনের কাজ করে থাকে। যখন যাকে টাকা দেবো এই প্রসেসগুলো সেই কমপ্লিট করে থাকে। মূলত ওই অফিসের অ্যান্ডরোমেন্টের দায়িত্বে যিনি আছেন তিনি সবকিছু পরিচালনা করে থাকেন। অনুসন্ধানের জন্য পাসপোর্ট অফিসে এই প্রতিবেদক গেলে জানা যায়, সহকারী হিসাবরক্ষক মোহাম্মদ ইয়াছিন নামে এক ব্যক্তি দায়িত্বে আছেন। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, দালালচক্র ও যে সকল দোকানদার সেবা গ্রহীতার আবেদন ফরম পূরণ করে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে থাকেন পাসপোর্ট অফিসের সহকারী হিসাবরক্ষকের দায়িত্বে থাকা এই মোহাম্মদ ইয়াছিনের সাথে তাদের অনেক সখ্যতা রয়েছে। তথ্য উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। প্রশ্ন হলো, পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না কেন? ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে সদিচ্ছা থাকলে তো এমনটি হওয়ার কথা নয়। পাসপোর্ট খাত দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সেবা খাতগুলোর অন্যতম।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) খানা জরিপ ২০২১ অনুযায়ী, ওই বছর দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে (৭০.৫ শতাংশ) ছিল এ খাত। এখনো এ খাতে ঘুস বাণিজ্য ও হয়রানি চলছে অব্যাহতভাবে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ সংক্রান্ত নানা তথ্য। শুধু নতুন পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রেই নয়, সরকার ই-পাসপোর্ট চালু করার পর সুযোগসন্ধানীরা মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) নবায়নের নামেও রমরমা ঘুস বাণিজ্যে মেতে উঠেছে। বিশেষ করে জাতীয় পরিচয়পত্রে তথ্যগত জটিলতার কারণে যারা ই-পাসপোর্ট করাতে পারছেন না, তারাই হচ্ছেন এর শিকার। ই-পাসপোর্ট এড়িয়ে মোটা অঙ্কের ঘুসের বিনিময়ে তারা নবায়ন করিয়ে নিচ্ছেন পুরোনো পাসপোর্ট। জানা গেছে, ক্ষেত্রবিশেষে এই ঘুসের পরিমাণ হয়ে থাকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। উদ্বেগের বিষয় হলো, যেসব অপরাধী  জাল-জালিয়াতি করে জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়াই ভুয়া জন্মনিবন্ধন দিয়ে এমআরপি করিয়েছিল, তারাও এখন ঘুসের বিনিময়ে এমআরপি নবায়ন করিয়ে নিচ্ছেন বলে ইতঃপূর্বে খবর বেরিয়েছে। হয়রানি ও দুর্নীতিমুক্ত সেবা পাওয়া জনগণের সাংবিধানিক অধিকার।
এ দিকে একজন পাসপোর্ট সেবা গ্রহিতা ভুক্তভোগী অভিযোগ তোলেন, নেত্রকোনা আঞ্চলিক পাসপোর্ট  অফিসে ঘুস ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া যায় না বললেই চলে।  সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার খর্ব করছে এবং এর ফলে প্রান্তিক ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  ভুক্তভোগী আরো বলেন, ” নেত্রকোনা পাসপোর্ট অফিস দুর্নীতির আঁতুড় ঘর। আমরা দেখছি দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখার পরও প্রবাসী শ্রমিকরা। আমার নিকট আত্মীয় পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে গিয়ে ইতিপূর্বে নানাভাবে দুর্ভোগ ও হয়রানির শিকার হয়েছিল। অথচ পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতিবাজদের কারণে একশ্রেণির মানুষ ঘুস দিয়ে অবৈধভাবে সেবা নিচ্ছেন। এ অবস্থা চলতে পারে না। সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানি, ভোগান্তি ও দুর্নীতিমুক্তভাবে পাসপোর্ট পেতে পারে, সে জন্য প্রতিটি পাসপোর্ট অফিসে অভিযান পরিচালনা এবং নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন।”সেবা গ্রহীতা রতন আলী জানান, “নেত্রকোনা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সামনে একটি দোকানে আমার কাছ থেকে উদ্বৃত্ত প্রায় তিন হাজার টাকা নিয়েছে। এসব টাকা না দিলে দিনের পর দিন অফিসে ঘুরতে হয় বলে অনেকের অভিযোগ আছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নেত্রকোনা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক উম্মে কুলসুম বলেন,” আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রোজা রাখি। কোনো প্রকার দুর্নীতির সাথে আমি জড়িত নেই। আমি অফিসে সবাইকে বলে দিয়েছি কেউ যদি কোনো উদ্বৃত্ত টাকা নিয়ে থাকেন তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের প্রশ্ন? যেহেতু পাসপোর্ট অফিসটি সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাহলে কিভাবে দালাল চক্র পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশ করে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নেত্রকোনা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি উজ্জ্বল বলেন, নেত্রকোনা পাসপোর্ট অফিসের বিষয়ে কি বলবো, এককথায় এটা অনিয়ম দুর্নীতির আঁতুরঘর। এখানে যিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে আছেন উম্মে কুলসুম তিনি ও তার স্বামী ময়মনসিংহ পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক মোরাদ চৌধুরী তাদের ইন্ধনেই এই অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Releated

নেত্রকোনায় গুলিতে একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান হারিয়ে অকুল পাথারে রাসেলের পরিবার

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : গুলিতে নিহত রাসেল মিয়া। গাজীপুরের মাওনায় মোরগের গাড়িতে হেলপারের কাজ করতেন রাসেল মিয়া (১৯)। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণের জন্য কিশোর বয়স থেকেই এ কাজে যোগ দিয়েছিলেন। গত ৫ আগস্ট বিকেলে মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের পোশাক পরা ভারতীয়দের আটক করে জনতা। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ভগ্নীপতির […]

নেত্রকোনায় বিদ্যালয়ের কাজ না করেই বরাদ্দের টাকা ৫০ লাখ টাকা উত্তোলনের অভিযোগ

Share the post

Share the postসোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোণা : নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার বরইতলা এন আই খান উচ্চ বিদ্যালয়ের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হলেও প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু হয়নি।২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে উন্নয়ন সংশোধিত বাজেটে ‘ইউনিয়ন পরিষদ উন্নয়ন সহায়তা’ খাতের আওতায় ইউনিয়নের অনগ্রসরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং […]