সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা : রাখাল অন্যের গরু-বাছুর বা গবাদি পশু মাঠে ছড়িয়ে জীবন-সংগ্রাম যার। আবহমান গ্রামীণ বাংলার অবিচ্ছেদ্য চরিত্র হলো রাখাল। হাল আমলে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, শিল্পায়নের বিকাশ, খামারভিত্তিক বাণিজ্যিক প্রাণিসম্পদ লালনপালনের ফলে গ্রামীণ বাংলার এই অবিচ্ছেদ্য চরিত্র রাখাল হারিয়ে যেতে বসেছে। একসময় বাংলার প্রতিটি গ্রাম, গ্রামীণ জনপদ, অবস্থাশালী গৃহস্থ তথা কৃষকের ঘরে রাখাল ছিল পরিবারের সদস্যদের মতোই। এই রাখালকে নিয়ে গ্রামবাংলায় কত সহস্র কিসসা, লোকগাথা, ঘটনা-রটনা গড়ে উঠেছে তার সঠিক হিসাব নেই। এ ছাড়া যাত্রাপালা রাখালবন্ধু, রাখাল রাজা আর পরে এ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ও অনেক টিভি নাটকে রাখালকে তুলে ধরা হয়েছে গ্রামবাংলার নায়ক হিসেবে। এসব লোকগাথায় রাখাল ও তার বাঁশির সুরে কত যুবতী তথা নারীকে উতলা দেখানো হয়েছে, কতশত যুবতীকে রাখালের বাঁশির সুরে পাগল হয়ে ঘর ছেড়ে আসতে দেখানো হয়েছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া দুস্কর। রাখালবন্ধু পরে রঙিন রাখালবন্ধু সিনেমা ও যাত্রাপালার অমর গানটি আজও গ্রামবাংলার লোকমুখে। যেখানে রাজকন্যা রাখালের উদ্দেশে বলছে :গরু লইয়া যাওরে রাখাল শুনিয়া উদাসী/ফোটা ফুলের গন্ধ ভালো মুদ্রানো মুকুলরে/প্রাণ কান্দে রাখাল বন্ধুরে।/নিত্য আসো নিত্য রে যাও এই না পন্থ দিয়া/বনের ভ্রমর পাগল করো বাঁশরী বাজাইয়া/পুবালি বাতাসে বাঁশি বাজাও ধীরে ধীরে/ফুল ছাড়িয়া ফুলের ভ্রমর উড়িয়া উড়িয়া ফেরেরে/প্রাণ কান্দে রাখাল বন্ধুরে।
জবাবে রাখাল রাজকন্যার উদ্দেশে গায় :আমি তো গরুর রাখাল মাঠে মাঠে থাকি/বাঁশরী বাজাইয়া পালের গরু-বাছুর ডাকিরে/কান্দে বাঁশি কার লাইগারে।/কী বুঝিমু ফুলের গন্ধ, কী বুঝিমু ফুল/বারণ করলে তুলিব না এই বাগানের ফুল/আমি যে রাখাল তুমি রাজারো ঝিয়ারী/নিষেধ দিলে বাজাইবো না আমারও বাঁশরীরে/কান্দে বাঁশি কার লাইগারে।/এই না চরের শেষ সীমানায় আমার বসতগাঁও/বাবলা বনে ঘুইরা যাইতে লাগে ডিঙ্গা নাও/এই না পন্থে যাইতে কন্যা বারণ করো যদি/তেপান্তরের পথে যাইমু সাঁতারিয়া নদীরে/কান্দে বাঁশি কার লাইগারে। শেষে রাজকন্যা রাখালের উদ্দেশে বলে :মাঠে থাকো গরু রাখো কথার না পাও দিশ/বাড়িত গিয়া বাউজির সনে কইরো পরামিশ/কাইল দুপুরে গরু লইয়া এই না পন্থ দিয়া/বাবলা বনে যাইও আবার বাঁশরী বাজাইয়ারে/প্রাণ কান্দে রাখালবন্ধুরে। আর এরই মধ্যে হয়ে গেল রাখাল আর রাজকন্যার প্রেম-প্রণয়। সব ঝড়-ঝাপ্টা অতিক্রম করে রাজকন্যা একসময় ঘর বাঁধে রাখালের সঙ্গে। বাংলার লোকগানে ও লোকগাথায় রাখালের প্রেমে বা তার বাঁশির সুরে জমিদারকন্যা বা রাজকন্যাকে প্রেমে ফেলা হয়েছে। কোনো কোনো কাহিনিতে গৃহকর্তার কন্যাকে রাখালের প্রেমে পড়তে দেখা গেছে। রাখাল ও গৃহকর্তার মেয়ের অসম প্রেমের অনেক ঘটনা বাস্তবেও ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রেমের জয় হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে হয়েছে ব্যর্থ। আর ব্যর্থ প্রেমের করুণ পরিণতি হয়েছে রাখালকে পরাজিত-লাঞ্ছিত হয়ে এলাকা ত্যাগ। অনেক ক্ষেত্রে প্রেমিকার আত্মহনন। আবার এক রশিতে রাখাল ও গৃহস্থ আত্মহননের ঘটনাও আমাদের গ্রামীণ জনপদে ঘটেছে। বাংলা সাহিত্যে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ হলো ‘রাখালী’। পল্লীকবি জসীম উদ্দীন লিখেছেন :ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ,/কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা,/সেথায় আছে ছোট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,/সাঁঝ-আকাশের ছড়িয়ে-পড়া আবীর রঙে নাওয়া।
এ ছাড়া অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাসে রাখাল চরিত্র নায়কের সিংহাসন জুড়ে বসে আছে। এ লেখায় আবহমান গ্রামীণ বাংলার একজন রাখালের জীবনচরিত তুলে ধরছি : ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার কথা হয় রাখাল হেলাল মিয়ার সঙ্গে। বয়স ৩৬ কিংবা ৩৭। প্রতিদিন পাঁচ/ছয় মাইল দূরের কয়েকটি গ্রাম থেকে তিনশ গরু নিয়ে আসেন হাওরের এই বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গৃহস্থের বাড়ির সামনে বাঁশি বাজালে বা ডাক দিলেই গরুগুলো নিজ নিজ গোয়ালঘর থেকে নেমে এসে রাখাল হেলাল মিয়ার সঙ্গে পথ ধরে হাওরের উদ্দেশে। সারাদিন গরুগুলো চড়িয়ে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লে আবার ফিরে যান গৃহস্থের বাড়িতে। গরুগুলো যার যার বাড়ির সামনে গেলেই দৌড়ে নিজ নিজ গোয়ালে চলে যায় নিজ দায়িত্বে। শুস্ক মৌসুমে ছয় মাস হেলাল মিয়ার অধীনে থাকে এই তিনশ গরু। প্রতি মৌসুমের জন্য গরুপ্রতি পান দুই মণ করে ধান। সে হিসাবে ছয় মাসে ছয়শ মণ ধানের মালিক হন রাখাল হেলাল মিয়া। সেটা দিয়েই চলে তার ঘর-সংসার। ঘাস খেতে খেতে কোনো গরু পথ হারিয়ে ফেললে বা অন্য রাখালের গরুর পালে চলে গেলে সেটাকে খুঁজে বের করাই হলো হেলাল মিয়ার দায়িত্ব পালনের মূল চ্যালেঞ্জ। কদাচিৎ কোনো কোনো ষাঁড় গরু বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লে তাদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনেন হেলাল মিয়া। অনেক সময় ঘাস খাওয়া ছেড়ে কোনো কোনো ষাঁড় পিছ ধরে গাভির। সে সময় রাখাল হেলাল মিয়াকে একটু বেরসিক হতে হয়। স্বাভাবিকভাবে গরুগুলো শৃঙ্খলা মেনে চলে, হেলাল মিয়ার অধীনতা মেনে চলে। হেলাল মিয়া ডাক দিলেই তার কাছে চলে আসে গরুগুলো। কয়েকটি গরুর নামও তিনি দিয়েছেন। নামকরণে প্রাধান্য পেয়েছে বাংলা ও হিন্দি সিনেমার নায়ক-নায়িকার নাম। গরুগুলোর সঙ্গে এক আশ্চর্য ধরনের রসায়ন গড়ে উঠেছে হেলাল মিয়ার। বর্ষাকালে চারদিকে থৈথৈ পানি থাকায় যার যার গরু তার তার গোয়ালে থাকে। কচুরিপানা খেয়ে বর্ষা পার করে গরুগুলো। সে সময় রাখাল হেলাল মিয়াকে অন্য কোনো কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।