জাতীয় অর্থনীতিতে শিক্ষার প্রভাব
মোঃ শাহ্ নেওয়াজ মজুমদার: পরিকল্পিত শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সামাজিক ও শিক্ষার উন্নয়ন আনয়ন করা সম্ভব। শিক্ষা একটি দেশের অর্থনীতিতে মানব সম্পদ ও মানব পুঁজি তৈরি ও সরবরাহ করে থাকে। যা অর্থনৈতিকভাবে আমাদের কৃষি, শিল্প ও অন্যান্য সামাজিক খাতের উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিকল্পিত শিক্ষার সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক কঠিন যোগসূত্র রয়েছে। জাপান সহ পৃথিবীর অনেক দেশের পরিকল্পিত শিক্ষা পরিকল্পনা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের যোগসূত্র শিক্ষা অর্থনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পরিকল্পিত শিক্ষা ইউরোপীয় দেশগুলোতে অর্থনীতির ন্যায় দেশ ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়ন করেছে। পরিকল্পিত শিক্ষায় নারীরা ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠির উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করে । আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশ সমূহের গতিধারা, পদ্ধতি এবং কৌশল নিয়ে পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে মত পার্থক্য থাকলেও শিক্ষাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসাবে স্বীকার করেন ও কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি করে এইরূপ শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। কারণ কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের কৃষি, শিল্প, ট্রান্সপোর্ট, তথ্যপ্রযুক্তি প্রভৃতি খাতে উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়।
বিভিন্ন দেশের বিগত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমানে এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সুপরিকল্পিত শিক্ষাই উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মানব সম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরাসরি সাহায্য করতে পারে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে অনেক বড় সাফল্য বয়ে আনতে পারে। বাংলাদেশ আজ সল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধিসহ জীবন যাত্রার বেশ কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি পরিলক্ষিত। সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে “Vision 2021” প্রণিত হয়েছে। যেখানে শিক্ষার উন্নয়নের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সহ¯্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্যসমূহ (Millennium Development Goals) অর্জন সহ বর্তমানে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য সমূহ (Sustainable Development Goals) অর্জনের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার পরিকল্পিত বিকাশের জন্য জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন, সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি মানব সম্পদ গঠনের মাধ্যমে শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নের সহগ হিসাবে নির্ধারন করা হয়েছে।
শিক্ষা পরিকল্পনার প্রধান কাজ হলো দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জনসম্পদের চাহিদা নিরুপন করা এবং চাহিদা অনুসারে প্রয়োজনীয় জনশক্তি তৈরি ও সরবরাহ নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকার বাজেটে বরাদ্ধকৃত অর্থ যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত কল্পে কাজ করছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেটে মোট জিডিপি: শতকরা ২.৭২% ভাগ। টাকার হিসাবে প্রতি বছর শিক্ষাখাতে বাজেটে টাকার পরিমান বাড়ছেই কারন আমাদের বাজেট প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে।উপযুক্ত প্রশিক্ষনের মাধ্যমে জনশক্তিকে যদি জনসম্পদে পরিনত করা যায় তাহলে তা পৃথিবীর শ্রেষ্ট সম্পদে রুপান্তরিত হতে পারে। তাই আমাদের জনশক্তিকে দক্ষ জনসম্পদে পরিনত করতে হলে তাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশের ও বেশী তরুন ও কর্মক্ষম এটাকে অর্থনীতির ভাষায় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বলে। একটি জাতীর জীবনে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট অবস্থা একবারই আসে, যারা সেই আস্থাকে কাজে লাগাতে পারে তারাই সফল হয়। আমাদের সরকার এই অবস্থাকে কাজে লাগাতে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্ধ সহ গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
১৯৯৯ সালে অমর্ত্য সেন তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন “যে কোন ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত যেমন, অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে জাপানের আবির্ভাবের পূর্বে তাদের শিক্ষার হার ও মান ছিল অতি উঁচু। সংগত কারনেই বলা যায়, শিক্ষায় প্রয়োজনীয় ও পরিকল্পিত বিনিয়োগ একটি জাতীকে কিভাবে পাল্টে দেয় তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরন হচ্ছে জাপান। বহু আগে জাপান শিক্ষাকে বিশাল পুঁজিতে রূপান্তরিত করেছে। শতভাগ শিক্ষিত জাপানিদের অর্থনৈতিক সম্পদের মধ্যে ১ শতাংশ প্রাকৃতিক পূঁজি, ১৪ শতাংশ ভৌত ও বস্তুগত পূঁজি এবং ৮৫ শতাংশ শিক্ষা সংক্রান্ত মানবিক ও সামাজিক পূঁজি। শিক্ষায় বিনিয়োগের Rate of Return অনেক বেশী। বর্তমানে আমরা সকলেই জানি ও অনুধাবন করি একজন শিক্ষিত শ্রমিক ও কায়িক শ্রমিকের আয় বৈষম্য তাই আমাদের অবিভাবকগন শিক্ষার প্রতি অনেক বেশী আগ্রহী। আধুনিক গবেষণায় দেখা যায় শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ তার আয়কে ৫ থেকে ১০ গুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারেন।
দার্শনিক প্লোটো বিশ্বাস করতেন, একটি সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিক্ষা অপরিহার্য। তার মতে “Education is indispensable for the economic health of a good society” অ্যাডাম স্মিত শিক্ষাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে শিক্ষাকে মূলধন হিসাবে গন্য করেছেন। আবার অনেকে মনে করেন শিক্ষা হচ্ছে সু-অভ্যাস গঠন আত্বোন্নয়নের আকাংখা, নৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং ব্যাক্তিগত দায়িত্ব বোধ জাগরনের উপায়, এদের কথা থেকে একথা ষ্পষ্ট যে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার বিকল্প নেই, সেটি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্যেও সত্য। নারী ও পুরুষ উভয়কে শিক্ষা গ্রহনের হারের মধ্যে সমতা আনয়নের মাধ্যমে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব। সাধারনত শিক্ষিত ও দক্ষরা বেশী উপার্জন করে তাই শিক্ষার মাধ্যমে এই ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। পাঠ্য বইয়ের শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে বা কর্ম জীবনের সাথে সমন্নয় করতে হবে। শিক্ষাকে আমাদের অর্থনীতি ও সমাজের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ করে একুশ শতকের লক্ষমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে নিতে হবে। এমতাবস্থায় দেশকে গোটা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষার অবদান হচ্ছে অনস্বীকার্য। তাই সঠিকভাবে প্রয়োজনমুখী ও জীবন ঘনিষ্ঠ শিক্ষা গ্রহনের মাধ্যমে টেকসই জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব।